শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায়?


আশিকুর রহমান প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৫, ২০২৩, ৫:৫৬ অপরাহ্ণ /
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায়?

আশিকুর রহমান: বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ যেখানে রাষ্ট্রের উন্নতি, শিক্ষা-গবেষণা, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবার, সমাজ ও নিজের স্বপ্ন নিয়েই একজন শিক্ষার্থী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। স্বাভাবিকভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের থেকে ইতিবাচক প্রত্যাশা রাখে। ছাত্রসমাজ উচ্চ শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে সমাজ তথা রাষ্ট্র সুগঠনে অবদান রাখবে এজন্য ছাত্রসমাজের প্রতি দায় সমাজ ও রাষ্ট্রের রয়েছে। ছাত্রসমাজ রাষ্ট্রের সচেতন সমাজের একটা অংশ তথা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। সচেতন ছাত্রসমাজ রাষ্ট্র বিনির্মাণে ভবিষ্যতে নিজ সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবে এমনটাই প্রত্যাশা কিন্তু সেই প্রত্যাশা যখন মাটির তৈরি পুতুলের মত ঠুনকো হয়ে পড়ে তখন ছাত্রসমাজকে ইতিবাচক সাড়ার চেয়ে নেতিবাচক প্রত্যাশাই বেশি প্রভাবিত করে। একটি দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ওপর রুটিন মাফিক বর্বরোচিতভাবে মারধর, ছাত্রী হেনস্তা, লাঞ্ছনাসহ প্রাণনাশের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা সচরাচর ঘটলে তখন আসলে প্রত্যাশার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

সম্প্রতি, গত শুক্রবার ১৯ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিতার হলে একটি কক্ষে অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সামছুলকে তিন ঘন্টা আটকে রেখে রড ও স্টাম্প দিয়ে মারধর করাসহ টাকা কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। একজন শিক্ষার্থী যখন নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আশেপাশের পরিবেশে কিংবা হলে পূর্ন নিরাপত্তা নিয়ে থাকার কথা তখন তাকে ভোগাতে হচ্ছে চরম হেনস্তা ও মারধর। গত ৭ অক্টোবর ২০১৯ সালে বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগ নেতারা পিটিয়ে হত্যা করে। এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস কিংবা হল কতটা নিরাপদ তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। হলের অভ্যন্তরীণে একপক্ষ অন্যপক্ষের সাথে মারমুখী অবস্থানে থাকার ফলে হলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় ও শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও পার্শ্ববর্তী এলাকা গুলোতে ছাত্রীদের উত্তোক্ত ও যৌন হয়রানীর মত লোমহর্ষক ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে। রাজনৈতিক সহিংসতা, অপরাজনীতি, সিনিয়র কর্তৃক জুনিয়র হেনস্তার শিকার এসব শিক্ষার্থীদের এক আতঙ্কের নাম। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলে ক্যাম্পাসগুলোতে যখন তখন বিশৃঙ্খলা দেখা যায় এতে ভুক্তভোগী হয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে চলাচল, ক্লাস কিংবা আড্ডার সময়টাতেও তাদের নিরাপত্তাহীনতার কথা স্বরণ রেখে চলতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে ও দুশ্চিন্তায় ভোগে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ড ও আতঙ্কের ফলে অনেক মেধাবি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে অনীহা প্রকাশ করে। এতে শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক ধারণার তুলনায় নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। মেধাবী শিক্ষার্থী অবক্ষয়ের অন্যতম কারন হচ্ছে শিক্ষার্থীর নিরাপত্তাহীনতা। প্রতিটি ব্যক্তির যেমন বসবাসের জন্য চাই নিরাপদ আবাসস্থল তেমনি শিক্ষার্থীদের চাই নিরাপদ পড়াশোনার পরিবেশ। অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ পরিবেশে শিক্ষার্থীদের মনে ভীতির সঞ্চার করে পড়াশোনায় ব্যাঘাতের সৃষ্টি হয়। বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো যেন ভয় ও আতঙ্কের অভয়ারণ্য। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা হলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ থাকবে কিন্তু বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানী, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড তাদের ভীতু করেছে। সন্ধা নামলেই মেয়ে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের আশেপাশে নিরাপত্তার অভাববোধ করে। তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দিহান। কিছুদিন পূর্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিরাপত্তার অভাববোধটি সবার সামনে এসেছে। দিনে দিনে কোন না কোন ক্যাম্পাসে এসব অপকর্মের দৃশ্য বারবারই প্রতিফলিত হচ্ছে এতে জাতির কাছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিসেবে ছাত্রসমাজের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অন্যায়, অপরাধ, অনিয়ম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে-এটা ছাত্রসমাজের পবিত্র দায়িত্ব কিন্তু যে ছাত্রসমাজ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো দেশ রক্ষার আন্দোলনে নিজের জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করে গেছেন সেই ছাত্রসমাজের সম্মান যেন পদে পদে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এমন অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ডে। যেখানে নিরাপত্তা নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় ব্যস্ত থাকার কথা সেখানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে শিক্ষার্থীরা। দিনে দিনে শিক্ষার্থীদের প্রতি এমন হেনস্তা, নিরাপত্তাহীনতা ছাত্রসমাজের ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গুলোর অভিভাবক থাকলেও অভিভাবক নেই সাধারণ ছাত্রসমাজের। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেন উন্মুক্ত আকাশের নিচে খাঁচায় বন্দী পাখির মতো।

images 8

এভাবে একজন শিক্ষার্থীর জীবন জিম্মি হয়ে যাওয়া কখনোই রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হতে পারেনা। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়-শিক্ষার্থীদের আস্থা ও নিরাপত্তা কোথায়? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোথাও কোন দায়বদ্ধতা নেই, নেই কোন নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা যদি শিক্ষার্থীদেরই নিশ্চিত করতে হয় তাহলে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যেন প্রবল বৃষ্টিতে মাথার উপর কচু পাতা ধরারই সামিল। বিগত দিনে দেখা গিয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মারধরের ঘটনা ঘটে। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা সংকট ভয়াবহ বার্তা দেয়। এসব অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের হুমকি ও রক্তাক্তের শিকার হতে হয়। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতার অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিরাপদ ব্যবস্থারই বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিরাপদ করা আর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত বর্তমান সময়ে দুটোরই অভাব। শিক্ষার্থী হিসেবে তার নিরাপত্তা দেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব। শিক্ষার্থী যেন নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে সেদিকে যথাযথ নজর দিয়ে কার্যকরী ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে হবে। শিক্ষার্থীরা নতুন প্রজন্ম, দেশ গড়ার হাতিয়ার। অন্যায়ভাবে ছাত্রসমাজের ওপর হামলা ও নির্যাতনে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা এবং অতি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। অপরাধী যেই হোক না কেন, তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার অপসংস্কৃতি বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

প্রকাশিত: দৈনিক শেয়ারবিজ
প্রকাশকাল: ২৬ আগস্ট, ২০২২
লিংক: https://shorturl.at/dnBJL

FB IMG 1692099587882