মা বাবা যখন স্বপ্নের হত্যাকারী!


আখতার হোসেন আজাদ প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৩, ২০২৩, ১:০০ পূর্বাহ্ণ /
মা বাবা যখন স্বপ্নের হত্যাকারী!

আখতার হোসেন আজাদ: মা কিংবা বাবা কতই না মিষ্টি শব্দ! সন্তানের জন্মের পর থেকে বাবা মা অনেক কষ্ট করে লালন-পালন করেন। ধীরে ধীরে সন্তান যখন পরিণত বয়সে উপনীত হয়, তখন তার নিজস্ব চিন্তাশক্তি, ভাললাগার অনুভূতি তৈরি হয়। যেমন কারও গান গাইতে ভালো লাগে, কেউবা আবার ছবি আঁকতে ভালোবাসে। কেউ কবিতা আবৃত্তি করতে ভালোবাসে তো কেউ আবার ছড়া, কবিতা, গল্প লিখতে ভালোবাসে। কারও আবার স্বপ্ন থাকে খেলোয়ার হবার। কিন্তু আমাদের বাবা-মায়েরা সন্তানের অনেক সময় এসব ইচ্ছার কোনো মূল্যই দিতে চান না। প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণে এসবের কোনোটি তো নয়ই; বরং পড়ালেখার পাশাপাশি এসব চর্চাতেও বাঁধা আসে। আমাদের সমাজে অভিভাবকেরা মনে করেন, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে একমাত্র পথই আছে এবং সেটি পড়ালেখা আর পড়ালেখা।

শিশুমনের যে একটি আত্মা রয়েছে, তাতে যে কোনো কিছুর চাহিদা থাকতে পারে তা যেন আমাদের বাবা মায়েরা ভুলেই যান। সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অভিভাবকদের চেষ্টার কোনো কমতি থাকে না। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত চেষ্টার ফলে শিশুমনে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে কি না সেটি দেখার সময় বা কোথায়! গণিতে ৯৮ পেলে বাকি ২ মার্কস কেন পায়নি তার জন্য বাবা মায়ের কাছে যেখানে জবাবদিহি করতে হয়, সেখানে অন্যকিছু ভাববার অবকাশ থাকতেই পারেনা। সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার পরে কোনোরকমে নাস্তা করিয়ে নিজের ওজনের চেয়ে ভারী বই বোঝায় করা ব্যাগ ঘাড়ে চাপিয়ে পাঠানো হয় স্কুলে। এরপর দুপুরে বাসাতে এসে তড়িঘড়ি করে গোসল ও দুপুরের খাবারের পর শুরু হয় কোচিং সেন্টারে পাঠানোর প্রস্তুতি। কোচিং থেকে এসেই সন্ধ্যার পরেই ঘটে প্রাইভেট টিউটরের আগমন। শিশুকাল থেকেই এমন চাপ প্রয়োগের ফলে শিশুমনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না। পড়ালেখার অতিরিক্ত চাপে শিশুমনের কোমল হৃদয় বাইরের জগতের আলো থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকে। থাকেনা সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের

কোনো পথও। এভাবেই হত্যা করা হয় অসংখ্য সম্ভাবনাময় প্রতিভাসমূহকে। পড়ালেখা চাপানোর পরে ক্যারিয়ার প্রশ্নেও সন্তানের কাছে কখনও জানতে চাওয়া হয় না যে সে বড় হয়ে কি হতে চাই? আমাদের সমাজের সন্তানদের বাল্যকাল থেকেই শিখিয়ে দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে সে কি হবে। বাবা-মা ঠিক করে দেন সন্তান ডাক্তার নাকি ইঞ্জিনিয়ার হবে। জন্মের পর থেকে সন্তানকে যেন বাবা মায়ের সাধ পূরনের গল্পই লিখে যেতে হয়। হতে পারে বাবা মায়ের ইচ্ছে সন্তানকে ডাক্তার হবার জন্য বাবা মায়ের ইচ্ছে বিদেশে পাঠানো; কিন্তু হয়তো সন্তান চাইছে দেশেই পড়ালেখা করে সমাজসেবায় নিজেকে উৎস্বর্গ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু বাবা মায়েদের জেদের কাছে সন্তানেরা নিজের স্বপ্নটাকে ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয়। বিশেষ করে এটি ঘটে যখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়। হয়ত সন্তানের ইচ্ছে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, কিন্তু বাবামায়ের ইচ্ছে ছেলেকে ডাক্তার বানাবেই। বাধ্য হয়েই সে মেডিকেলের জন্য ভর্তি প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

যখন সে সরকারি মেডিকেলে ভর্তি হবার সুযোগ না পায়, তখন কোনো বেসরকারি মেডিকেলে তাকে ভর্তি করানো হয়। ছেলেকে যে ডাক্তার বানাতেই হবে। এটি শুধুমাত্র একটি উদাহরণ মাত্র। আবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি শুরুর পরে যদি সন্তান কাক্সিক্ষত প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ না পায়, তবে অভিভাবকের কথার তীর বর্ষণ তো থাকেই। বাবা মায়ের বকুনি সহ্য করতে না পেরে সন্তানের আত্মহত্যার ঘটনাও আমাদের সমাজে রয়েছে। একটি প্রবাদ আছে- ‘আত্মার স্বাধীনতা যদি খর্ব করা করা হয়, পৃথিবীর সকল ধন-দৌলত সেখানে তুচ্ছ’। সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকে অভিভাবকদের দৃষ্টিপাত করতে হবে অবশ্যই। পরামর্শ দিতে হবে, ভালো-মন্দ দিক বোঝাতে হবে। কিন্তু সন্তানের উপর কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। স্মরণে রাখতে হবে, আত্মার স্বাধীনতাই পরম প্রশান্তি।

প্রকাশিত: দৈনিক জনতা

প্রকাশকাল: ১৯ জুলাই, ২০১৯