নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রয়োজন বিশ্বমান


ruhul প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২, ২০২৩, ৩:৩৭ অপরাহ্ণ /
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রয়োজন বিশ্বমান

মো: রুহুল আমিন: বিশ্বমানের দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য দিন দিন দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এটি আমাদের জন্য আনন্দদায়ক খবর কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি আদৌ বিশ্বমানের? বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর নাজুক অবস্থা। ২০২৩ সালের কিউএস ওয়ার্ল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং এ ১-৮০০ মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ৮০১-১০০০ এর মধ্যে বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট এবং ঢাবি, বেসরকারি দুইটি। কিউএস ওয়ার্ল্ড আটটি ভিন্ন মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে র‌্যাংকিং করে থাকে। এর মধ্যে একাডেমিক কার্যক্রম এবং বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী অন্যতম। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নের দিকে নজর না দিয়ে শুধু নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে ব্যাস্ত। ইউজিসি ওয়েবসাইট তথ্যমতে বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৪ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ৫ই অক্টোবর, ২০২৩ খ্রি. দেশে আরও ৬ টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করেছে ইউজিসি। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর রয়েছে নানান অসুবিধা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে নেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ। ২০২০ সালের তথ্য নিয়ে তৈরি বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলার মধ্যে ৩৮ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ব্যায় ৭২ কোটি ৯০ লাখ ৬২ হাজার টাকা। ৮ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে কোন টাকা ব্যায় করেনি। এর মধ্যে একাধিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বছরে দুই চারটি প্রকাশনা ছাড়া অন্য কোন গবেষণা করেনি। অনেক বিশ্বিবদ্যালয় গবেষণা খাতে নামমাত্র খরচ করে দায় সেরেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল ছাত্রদের দিকে। কিন্তু তাদের খাওয়ানো হচ্ছে পশু খাদ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিনগুলাতে নেই শিক্ষার্থীদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা৷ জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাদের খেতে হয় অখাদ্য। মাঝে মাঝে খাবারের মধ্যে পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রকারের সুস্বাদু পোকা, পঁচা ডিম, বাসি ডালসহ আরো কত কিছু। যাদের মেধা দিয়ে সরকার ভবিষ্যতে দেশের ভালো কিছু আশা করে তারা পুষ্টিকর খাবার না পেলে তাদের মেধা বিকশিত হবে কেমন করে, তা এখন উদ্বেগের বিষয়। সরকার রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন, বিভিন্ন সেতু ও ট্যানেল নির্মান করছেন হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে। এসব নির্মাণ কাজে বাইরের দেশ থেকে জনবল নিয়ে আসতে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এসব টাকা বাইরে ব্যায় না করে নিজ দেশের ছাত্রদের পিছনে ব্যায় করে তাদের যোগ্য করে তুলতে পারতো কিন্তু এমন পদক্ষেপ নাই বললেই চলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা। তাদের পড়াশোনা ও গবেষণা করার জন্য নেই পর্যাপ্ত পরিবেশ। জাতির মেধাবী শিক্ষার্থীদের গনরুম নামক বস্তিতে থাকার ন্যায় মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। আবাসিক হলগুলাতে সিট পেতে ধর্না ধরতে হয় ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাদের। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের ছাত্র সংগঠন গুলোর নৈরাজ্য বিরাজ করে আবাসিক হল গুলোতে। বৈধ সিট পেলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সাথে সখ্যতা না থাকলে নিজের বৈধ সিটে উঠতে পারে না। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতাদের নামে হলে সিট বানিজ্য এবং চাঁদা না দেওয়া শিক্ষার্থীকে মারধরের অনেক ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।  পর্যাপ্ত আবাসন না থাকায় প্রতিদিন ক্লাস পরীক্ষার জন্য তারা বাসে বাঁদুড়ের ন্যায় ঝুলতে ঝুলতে ক্যাম্পাসের বাসগুলোতে যাতায়াত করছে। আমাদের শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীগন যাতায়াত করেন তাপ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে। ক্যাম্পাসে কোনো বাসে সীট না হলে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাসে উঠতে চাইলেও উঠতে পারে না। তারা সিট ফাঁকা নিয়ে আসে কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের বাসে উঠানো হয়না। কোনো নতুন বাস ক্রয় করলে নাম দেন শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ব্যবহার করেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা।

বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে নেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ছাত্র ছাত্রীরা কোনো বিষয় নিয়ে কিছু বলেলে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধে গেলে পেতে হয় শাস্তি। এমনকি ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য ছাত্রছাত্রী বহিষ্কৃত হন। নেই ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ছাত্রছাত্রীরা তাদের যৌবনের মূল্যবান সময় নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা বাদ দিয়ে সময় টুকু ব্যায় করছে নোংরা রাজনীতিতে। রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা নিজেদের দল গোছাতে ব্যস্ত অথচ রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা স্বপ্ন দেখাচ্ছে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। যাদের নতুন কিছু উদ্ভাবনের বিষয় নিয়ে ধ্যান- জ্ঞান নিয়ে মেতে থাকার বিপরীতে তারা ব্যাস্ত স্লোগান দিতে, রাস্তায় মারামারি, হানাহানি করতে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা গণমাধ্যমে গুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া সংগঠনের এমন অবস্থা কেন? যে সংগঠন স্বাধীনতা যুদ্ধসহ দেশের ক্লান্তিলগ্নে বিভিন্ন শোষণ নিপিড়নে বিরুদ্ধে সচ্চার ছিলো তারা নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে ব্যস্ত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ও গবেষণা বাদ দিয়ে রাজনীতিসহ অন্যান্য কাজে বেজায় ব্যস্ত। পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জয়ের খবর দেওয়ার জন্য যখন অ্যান হুইলেয়ারকে নোবেল কমিটি থেকে যখন ফোন দেওয়া হয়, তখন তিনি ক্লাসে ব্যস্ত। একাধিকবার ফোন দিয়েও তাকে পায়নি নোবেল কমিটি। ক্লাস বিরতিতে আবার কল এলে তিনি রিসিভ করেন। নোবেল কর্তৃপক্ষ থেকে অ্যাডাম স্মিথ নামের এক ব্যক্তি অপর প্রান্ত থেকে কথা বলার জন্য সময় চান। অ্যানি জানান, আমি একটু ব্যস্ত, শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছি। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এর বিপরীত। তারা শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের চেয়ে রাজনীতি নিয়ে বেশী ব্যস্ত। বিভিন্ন পদ- পদবি ও অতিরিক্ত দায়িত্ব পাওয়ার আশায় ক্লাস বাদ দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি তাদের কাছে বড় । ফলে শিক্ষার্থীদের জীবনে নেমে আসছে সেশনজট নামের ভয়াবহ কালো অধ্যায়। শিক্ষার্থীরা সঠিক সময়ে পড়াশোনা শেষ করে বের হতে পারছেনা। শিক্ষকরা লাল- নীল- সাদা- কালো ও শাপলাসহ বিভিন্ন ফোরাম দল উপদলে বিভক্ত। তাদের নিয়মিত পাঠদান বাদ দিয়ে এসব রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতেই বিচরণ বেশি। বর্তমানে শিক্ষকরা একই রাজনৈতিক মতাদর্শের হয়েই কয়েক দলে বিভক্ত। বিভিন্ন দিবস ভিত্তিক অনুষ্ঠানে ফুল দেওয়া ক্রমান্নয় নিয়েও তাদের মধ্যে হাতাহাতি হতে দেখা যায়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি দুর্নীতির পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির বিরুদ্ধে নিয়োগ বানিজ্য এর ফোনালাপ ফাস হয়েছে এবং ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত কর্মচারীরা মাইকে করে সেটি প্রচার করেছেন। যারা জাতির পথপ্রদর্শক, জাতি ও ছাত্ররা যাদের কাছে থেকে শিক্ষালাভ করবে তারাই যদি এমন নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজের সাথে জড়িত থাকে তাহলে তাদের ছাত্রদের কাছ থেকে কি আশা করা যায়? সে প্রশ্ন রয়েই যায়!
বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের নিয়ে নানা অভিযোগ। শিক্ষকরা সিডিউল অনুযায়ী ক্লাস নেন না। কোনো কোনো শিক্ষক চার পাঁচ ঘন্টা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বসিয়ে রেখে বিকেলে ক্লাস নেন। আবার বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়ার জন্য চার- পাঁচ ঘন্টা  বসিয়ে রেখে ক্লাস না নিয়ে ছেড়ে দেন। কোনো শিক্ষার্থী কারণবশত দেরীতে আসলে শিক্ষল ক্লাসে ঢুকলে আর কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেন না কিন্তু তারা ঘন্টার পর ঘন্টা শিক্ষার্থীদের বসিয়ে রাখে। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম দেখলে সেই দিনই নিয়ে নেন টিউটরিয়াল পরীক্ষা। তবে সবাই এক না, এত এত কলুষিতের মাঝেও কিছু পিতৃতুল্য শিক্ষক আছেন যারা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবেন। তারা সঠিক সময়ে ক্লাস পরীক্ষা নেন এবং পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করেন। তারা নিয়মিত ক্লাসে আসেন এবং ক্লাসে পাঠদানের আগে সেই বিষয়ে পড়াশোনা করেন যেন নিজের সন্তান তুল্য ছাত্রদের সহজে বুঝাতে পারেন। তারা যেন সেশনজটে না আটকায় সেদিকে খেয়াল রাখেন। ছাত্র-ছাত্রী বিপদে পড়লে তাদের পাশে দাঁড়ান। অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের নিজের পকেটের টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। তারাই প্রকৃত শিক্ষক। এই মহান মানুষগুলোর জন্যই জাতি চিরকাল ঋণী হয়ে থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয় গুলো যেন কর্মকর্তা কর্মচারীদের পৈতৃক সম্পত্তি। ছাত্ররা প্রশাসনিক কাজে তাদের কাছে গেলে দেখা যায় তারা অফিস সময়ে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ আবার অফিসে চেয়ারকেই নিজের বেডরুম ভেবে ঘুমিয়ে পড়ছে। কর্মকর্তা কর্মচারীগন সঠিক সময়ে অফিসে আসেন না। অফিসে এসে বসার একটু পর লাঞ্চের সময় না হতেই লাঞ্চের নাম করে বাহিরে ঘুরাফেরা করতে থাকেন। নির্ধারিত লাঞ্চের সময় শেষ হলেও তারা তাদের অফিসে ফেরেন না। তাদের কাজের গাফিলতির জন্য ছাত্ররা তাদের নাম্বারপত্র ও সনদপত্র উত্তোলনসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে হয়রানির শিকার হচ্ছে। কর্মকর্তা কর্মচারীগন তাদের সন্তানদের ভর্তি পরীক্ষায় নির্ধারিত পাশ মার্ক না পেলেও পোষ্য কোটায় তাদের ভর্তি করানোর জন্য দিনরাত আন্দোলন করে যাচ্ছে। আন্দোলন করে অহেতুক সময় নষ্ট না করে সেই সময়টুকু যদি তাদের সন্তানদের ভর্তি যোগ্য করে তুলতেন তাহলে তাদের এই অহেতুক আন্দোলন করতে হতো না।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে অতিউৎসাহী না হয়ে পুরাতন গুলোর মান উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের আবাসন এবং পরিবহন নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে মেধার ভিত্তিতে আসন বরাদ্দ করা প্রয়োজন। হলগুলোর ডাইনিং এবং ক্যান্টিনে ভর্তুকির পরিমান বাড়িয়ে ছাত্রদের সুষম পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গুলাতে ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। ক্যাম্পাসে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলাকে তাদের নিজেদের মধ্যে দলাদলি  মারামারি হানাহানি বাদ দিয়ে নিজেরা ঐক্য বদ্ধ হয়ে ছাত্রদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষকদের রাজনীতির মাঠের চেয়ে ক্লাসের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। গবেষণায় বাজেট বাড়াতে হবে। শিক্ষক ও ছাত্রদের গবেষণা খাতে উদ্বুদ্ধ করতে গবেষণা খাতে প্রণোদনা দিতে হবে। জাতির তরুণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাতির বিভিন্ন সম্যাসার সমাধান ও নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হবে।

প্রকাশিত: শেয়ার বিজ এবং দৈনিক ইনকিলাব
প্রকাশকাল: ৮ এবং ১১ অক্টোবর, ২০২৩
লিংক: https://shorturl.at/blqG
https://shorturl.at/clCITবিশ্ববিদ্যালয় ইনকলিাব ১১.১০.২৩ বিশ্ববিদ্যালয় শেয়ার বিজ ০৮.১০.২৩