শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তের দায় কার?


আশিকুর রহমান প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৫, ২০২৩, ৮:১২ পূর্বাহ্ণ /
শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তের দায় কার?

আশিকুর রহমান: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও ডিগ্রি অর্জন করার জায়গা। যেখানে শিক্ষার্থীরা আসে তাদের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবিক রুপ দিতে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গন যখন মাদকের আস্তানা, শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ধ্বংসের মাধ্যম তখন সেখানে শিক্ষা অর্জনের চেয়ে মাদকের চর্চায় বেশি হয়। মাদক এক অভিশাপের নাম, ভয়ংকর ছোবলের নাম। এটি শুধু মাদকাসক্তের জন্ম দেয়না, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্পও ছড়ায়। কিন্তু পূর্বে সমাজের অলিতে গলিতে মাদকের ছড়াছড়ি থাকলেও বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো যেন মাদকের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। মাদকাসক্তের সংখ্যা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে দিন দিন প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বেড়েই চলছে। বিশেষ করে তরুণদের মাঝে ধূমপান একটি ফ্যাশন বা স্মার্টনেস অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। অপব্যবহারেই অভ্যাসের সৃষ্টি করে আর অভ্যাস নিয়ে যায় ধ্বংসের পথে। বিশ্বে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ অবৈধ মাদক গ্রহণের সাথে জড়িত যার অধিকাংশই তরুণ। তারুণ্য মানে ধুমপান, তারুণ্য মানে মাদকাসক্ত।

FB IMG 1691993287612 1

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর থেকে অধিকাংশ শিক্ষার্থী মাদকাসক্ত বন্ধু, সিনিয়র ভাইয়ের সাহচর্যে মাদকে জড়িয়ে পড়ে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ধূমপায়ী শিক্ষার্থীদের আনাগোনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইসব ধূমপায়ীদের বেশিরভাগই ক্লাস বর্জনকারী শিক্ষার্থী বেশী। তাদের কাঁধে সাইট ব্যাগ, হাতে মোবাইল ফোন, পকেটে সিগারেট ও দিয়াশলাই।
দোকান থেকে সিগারেট কিনে নির্জন স্থানে গিয়ে ধূমপান করে তারা। তাদের বাচন ভঙ্গি দেখে মনে হয় এটা একটা ফ্যাশন। প্রতিদিন সকাল বেলা থেকে শুরু করে ক্লাস বর্জনকারি এসব শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন নির্জন যায়গায় দেখা যায়। এদের অনেকেই শিক্ষকদের সম্মান না দিয়ে যেখানে সেখানে ধুমপান করে। রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের সংস্পর্শে অনেকে মাদকের সাথে মিশে অনৈতিক কর্মকাণ্ড করেন। যা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে ভাবমূর্তি নষ্ট করে। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে যেন মাদকের নেশাও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের কাছে। রাত হলে ক্যাম্পাসের মাঠ, নির্জন জায়গা, হলের ছাদে কিংবা নিজ কক্ষে মাদকের আসরে ডুবে থাকে শিক্ষার্থীরা। মাদক সেবনের নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে হল, যেংখানে পুলিশি বাধা কিংবা হস্তক্ষেপ নেই কারো। সমাজের বিভিন্ন স্তরে মাদক বিরোধী পুলিশি তল্লাশি হলেও তল্লাশি হয়না বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে। যার ফলে অবাধে ও নির্ভয়ে ক্যাম্পাসে মাদক নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। প্রশ্ন হলো- এর শেষ কোথায়? কে ফেরাবে শিক্ষার্থীদের মাদকের কবল থেকে? বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একটি হল যেন মাদকের কারখানা। যেখানে ভিতরেই মাদকের বেচাকেনা হয় কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই। এক্ষেত্রে হল কর্তৃপক্ষের কোন হস্তক্ষেপ নেই বললেই চলে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো যেন মাদকের এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস গুলোতে সহজেই মিলছে গাঁজা, ইয়াবাসহ দেশি বিদেশি নেশাজাতীয় পানীয়। গভীর রাতে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় মাদক সেবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। নেশাগ্রস্থ হয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে ক্যাম্পাসে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মনে করে ধুমপান বা মাদক গ্রহণ না করলে প্রকৃত স্মার্ট হওয়া যায়না, এই চিন্তাধারা থেকেও অনেকে মাদকে পা বাড়ায়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাদক বন্ধে নেই কোনো কঠোর পদক্ষেপ। নেই কোন জোড়দার ব্যবস্থা যেন শিক্ষার্থীরা মাদকে সেবন না করতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের অবাধে মাদক সেবন বেড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় প্রশ্ন জাগে- শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তের দায় কার? স্বল্পদাম এবং সহজলভ্য হওয়ায় এগুলোর ক্রেতা হচ্ছে মাদকসেবী শিক্ষার্থীরা। এই সহজলভ্যতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদকাসক্তের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। মাদক নির্মূলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কার্যক্রম নিলেও কিছুদিন পর দেখা যায় ক্যাম্পাস পূর্বের মাদকের রাজ্যে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মাদক নির্মূলে যৎসামান্ন পদক্ষেপ নিলেও দীর্ঘমেয়াদী কোন পদক্ষেপ নেন না। প্রশাসন কেন এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না? শুধু পদক্ষেপই নয়, বাস্তবায়ন করে শিক্ষাঙ্গনকে করতে হবে আদর্শস্বরুপ। দৈনিক প্রথম আলো ৩০ হাজার মাদকসেবীর তথ্য পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, যেখানে মাদকসেবী শিক্ষার্থী ২০১৮ সালে শতকরা ৫.২৩ শতাংশ, ২০১৯ সালে ১০.২৪ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১১.৬৮ শতাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ক্যাম্পাসের বিভিন্ন খোলা জায়গায়ও কিছু কিছু শিক্ষক প্রকাশ্যে ধুমপান করেন যা কিনা শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করে। শিক্ষার্থীরা যখন মাদকে বুঁদ তখন তারা শুধু নিজের ক্ষতিই করেনা বরং এটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গুলোতে মাদকাসক্তি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। অথচ মাদক নির্মূলে সেখানে নেই কোনো পেশাদার পরামর্শদাতা বা কাউনসেলর। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মাদক নির্মূল করতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা উচিত। তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সঠিক শিক্ষা ও গবেষণার আদর্শ পরিবেশ গড়ে উঠবে।

শিক্ষার্থীদের জন্য মাদক খুবই ভয়াবহ। এতে করে প্রথমেই বাঁধাগ্রস্থ হয় শিক্ষার্থীর মানসিক ও দৈহিক বিকাশ। মাদক ধ্বংস করে দেয় শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এক পর্যায়ে তারা হতাশ হয়ে মাদকের দাসে পরিণত হয়। গতদিন গুলোতে দেখা গিয়েছে জাবি, শাবিপ্রবিসহ বুয়েটের শিক্ষার্থীরা মাদক গ্রহণ ও সরবরাহের অপরাধে গ্রেফতার হয়। এমন দেশবরেণ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন ঘটনা তখনই ঘটে যখন মাদকের সহজলভ্যতা ও বাধা থাকেনা। এক্ষেত্রে প্রশাসনের অবহেলা আর যথাযথ পদক্ষেপের অভাবেই মাদকের বিস্তার বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর হল ও ক্যাম্পাসে। দেশে তামাকপন্য ব্যবহারকারীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বিড়ি ও ধোঁয়াহীন তামাক ব্যবহার করেন। এজন্য প্রয়োজন সঠিক সহপাঠী ও বড় ভাই নির্বাচন। শিক্ষার্থীদেরকে মাদকের এই ভয়াবহ কবল থেকে রক্ষা করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ ও ক্যাম্পাসসহ হলগুলোতে শিক্ষক মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে প্রতিটি হলে পরামর্শদাতা বা কাউনসেলর নিয়োগ। প্রতিবছর ভর্তি প্রক্রিয়ায় ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা করা এবং ভর্তি পরবর্তী ছয় মাস পরপর ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা। এমন কঠোর পদক্ষেপে শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্তের কবল থেকে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে আসবে বলে মনে করি। এজন্য ক্যাম্পাস গুলোতে মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইন করা, শিক্ষার্থীদের সচেতনতা, শিক্ষক ও প্রশাসনের বেশি দায়িত্বশীল হওয়া ও নৈতিক ভাবে সচেতন হওয়া ছাড়া শিক্ষার্থীদের এই পথ থেকে ফেরানোর বিকল্প নেই।

 

দৈনিক ডেল্টা টাইমস

৩১.০৭.২০২২

লিংক: https://shorturl.at/fwSX8

দৈনিক আমাদের সময়
০৪ আগস্ট, ২০২২
লিংক: https://shorturl.at/ckBV2

প্রকাশিত:দৈনিক সময়ের আলো
০২ আগস্ট, ২০২২
লিংক:  https://epaper.shomoyeralo.com/2022/08/02/

FB IMG 1691993287612 FB IMG 1691855026895