সাগরকন্যা কুয়াকাটায় একদিন


আশিকুর রহমান প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৪, ২০২৩, ১:৪০ অপরাহ্ণ /
সাগরকন্যা কুয়াকাটায় একদিন

আশিকুর রহমান: দিনটি ছিল বুধবার। ইংরেজি সনের ০২ মার্চ, ২০২২। সকাল থেকেই উত্তেজনা আর হৃদয়ের কম্পন যেন থামছেই না। সাগরকন্যাখ্যত কুয়াকাটায় যাব। দীর্ঘসময় করোনা মহামারির স্তব্ধতা ভেঙ্গে যেন এক পশলা বৃষ্টি নামল সকল ভ্রমন পিপাসুর হৃদয়ে।
আমরা ছিলাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপের পুরো ইউনিট। ভ্রমণের দুদিন পূর্বেই আজাদ ভাই (ইউনিট কাউন্সিল সভাপতি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ) জানিয়েছেন দুপুর ৩ টায় ক্যাম্পাস থেকে যাত্রা আরম্ভ করব। কিন্তু পরে জানতে পারলাম কোন সমস্যার কারনে যাত্রা শুরু হবে রাতে। সন্ধা ০৬:৩০ এ গেলাম রোভার ডেনে। একি অবস্থা সবার! সবাই উচ্ছাসিত আর খুশির জোয়ারে বইছে রোভার ডেনে। এদিকে অপেক্ষমান মন ছুটছে যেন সমুদ্রের পানে। বাস ছাড়ার পূর্ব মুহুর্তেই যেন সেলফি তোলার মহড়া শুরু হয়েছিলো সবার। অবশেষে সকল প্রস্তুতি শেষ করে রওনা দিলাম রাত ৮ টায়।
বাসে উঠেই যেন মনে হল বাসের গতির সাথে ক্রমেই দূরত্ব কমছে বহুল প্রতিক্ষিত সেই সাগরকন্যার।
মাগুরা পৌঁছালাম রাত ১০টায়। সেখানে আমরা রাতের খাবার খেলাম। খাবার শেষে তো ওয়ালিউল্লাহ ভাইকে( সিনিয়র রোভারমেট) তাঁর নিজ জেলা নিয়ে সবাই ইচ্ছামত পঁচানিও দিল। আবার রওনা দিলাম কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। একটু পরেই স্কাউট প্রার্থনা সঙ্গীত দিয়ে আজাদ ভাই শুরু করল আমাদের চলন্ত বাসের সাংস্কৃতিক পর্ব। শিক্ষা সফরের লটারি বিক্রির কাজ পেলাম। সবার কাছে লটারি বিক্রি করলেও সালেহ স্যার (সম্পাদক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ) ও মিরা আপু (সিনিয়র রোভারমেট) যেন পাত্তাই দিলনা আমার মত হকারকে। তবে বেশি ভাল লেগেছে হকার সেজে সবার কাছে লটারি বিক্রি করা। মধ্যরাতে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন তখন মুসা ভাই (ইউনিট কাউন্সিল সাধারন সম্পাদক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ ) ও আমি চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করায় ব্যস্ত।
পরদিন বৃহস্পতিবার। ভোর ৪টায় পৌঁছালাম কুয়াকাটায়। বাস থেকে নামতেই দেখি সবার উৎসুক নয়নজোড়া যেন সকালের সূর্যোদয় ও বেলা শেষে সূর্যাস্তের মোহে ছল ছল করছে। সবাই হোটেলে উঠলাম। ফ্রেশ হতে হতেই চলে এলো আমাদের বহনকারী কয়েকটি ভাড়া বাইক। রওনা করলাম সূর্যোদয় দেখার উদ্দেশ্যে। সমুদ্রের তীর ঘেষে, বালির উপর দিয়ে বাইক রাইডিং ছিল যেমন ভয়ংকর ঠিক ততটাই রোম্যান্সকর। মোতালেব একসময় তো বলেই দিল ‘আমার ভয় করছে’। ওকে সাহস দিলাম।
সমুদ্র তীর ঘেষা ঝাউবন, ছোট বাঁধ ও রাশি রাশি বালি পেরিয়ে পৌঁছালাম গঙ্গামতির চরে।
কেউ অপেক্ষা করছে সূয্যিমামার, কেউবা আবার সমুদ্রের স্মৃতি রাখতে ছবি তোলায় ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পরেই দেখা মিলল সবার আগ্রহের সূর্যের । যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে এক লাল রক্তিমার আবির্ভাব। অপরুপ সূর্যরশ্মি যেন ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হয়ে ছিটকে পড়ছে সবার শরীরের উপর। বিভিন্ন জেলা থেকে ঘুরতে আসা ভ্রমণ পিপাসুদের আনাগোনাও ছিল চোখে পড়ার মত। এরপর যাত্রা রাখাইন পল্লি, বৌদ্ধনাথ মন্দির ও কুয়াকাটা ঐতিহাসিক ‘কুয়া’র উদ্দেশ্যে। সেখানে রাখাইনদের জীবনব্যবস্থা ও তাদের কথা বলার ভাষার ভিন্নতা এই প্রথম দেখেছিলাম। দেখতে দেখতে নাস্তা করার সময় হলো। চলে এলাম হোটেলে।
তখন দুপুর, কড়া রোদ। সমুদ্রে এসেছে কিন্তু এত জলরাশি আর ঢেউয়ের মাঝে গোসল না করলে যেন ভ্রমণই বৃথা।
তীরে গিয়ে আমরা স্কাউট মোটো’র বাস্তব রুপ দিতে সমুদ্র তীর পরিচ্ছন্ন সেবা দেই। তারপর শুরু ফুটবল খেলা। কড়া রোদেও যেন সুভাষিত বাতাস মনকে প্রফুল্ল করছিল। নেচে উঠেছিলাম যখন আমার দল বিজয়ী হয়।
অতঃপর সবাই পর পর সমু্দ্রে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে গোসলের উদ্দেশ্যে। আমিও দিলাম। সমু্দ্রে ঢেউ এসে খেলা করতে লাগল শরীরে। কিছুক্ষণ পর পর ই জেলিফিস ভেসে উঠতে লাগলো। লবণাক্তের স্বাদও পেলাম। বেশি উচ্ছাসে তো রুহুল ঢেউয়ের প্রকোপে তার চশমাই হারিয়ে ফেলে। বিকেলের দৃশ্যে সমুদ্রের তীর ঘেষে লাল কাকড়া ও ঝিনুকের ছড়াছড়ি। কেউ লাল কাকড়া ধরছে আবার মিরা আপু, শ্যামলী আপু, ইতি ও রত্না ঝিনুক কুড়োয় ব্যস্ত। আজাদ ভাই, ওয়ালিউল্লাহ ভাই ও স্যারসহ তীরে দাড়িয়ে সমুদ্র উপভোগ করছে।
লাল কাকড়া অভয়ারণ্য, লেবু বন, শুটকির চরসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলো যেন এক একটা পার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার আদর্শ জায়গা।
কিছুক্ষণ পরেই সূর্য অস্ত যাবার পালা। অধীর অপেক্ষায় পর্যটকরা। সূর্য যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে। সূর্যের রক্তিম আভায় যেন সমুদ্রের বিশাল জলরাশি রক্তাক্ত। এই সূর্যাস্ত ছিল এক রোমান্ঝকর অভিজ্ঞতা।
ফেরার পথে সারি সারি সামুদ্রিক মাছ ও কাকড়ার দোকান। কুয়াকাটায় এসেছি, কাকড়া খাব না তা কি করে হয়! কেউ টুনো মাছ, কেউ কাকড়া ফ্রাই খেলো। দুটোর স্বাদ যেন এখনো লেগে আছে সবার মুখে মুখে।
রাত ৮টা। কেনাকাটায় ব্যস্ত সবাই। কেউ আচার, কেউ উপহার সামগ্রী। তুহিন তো হেড মাসাজার কিনে বেজায় খুশি।
আমি, রুহুল ও মোতালেব গেলাম সমু্দ্রে। চারপাশের নিস্তব্ধতার মাঝে রাতের সমু্দ্রের গর্জনে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।
পরদিন শুক্রবার। সকালে নাস্তা করে রওনা দিলাম ষাট গম্বুজ মসজিদের উদ্দেশ্যে। ফেরার সময় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, খান জাহান আলির মাজার, বাগেরহাট জাদুঘর ও ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ পরিদর্শন করলাম। নাম ষাট গম্বুজ হলেও এই মসজিদের গম্বুজ হিসাব করে দেখলাম গম্বুজ সংখ্যা ৭৭। মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। নান্দনিক ও ঐতিহাসিক স্থানে গিয়ে সেই ১৫শ শতাব্দীর খান জাহান আলির সময়ে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। দর্শনার্থীরা কেউ ছবি তুলছে, কেউবা নামাজ আদায় করছে। তবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সারি সারি পলাশ ফুলের দৃশ্যটায় মন আটকে গেছে।
সারাদিনের ভ্রমন শেষ করে যাত্রা শুরু করলাম ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। তখন মনে পড়ছিল হেমন্ত মুখার্জীর সেই গান ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’।
সমু্দ্র পানে মন ছুটছিল বারবার কিন্তু কী আর করার?
আবার ফেরার সুযোগ হলে রাতের স্তব্ধতা ও ঢেউয়ের গর্জনের কাছে গিয়ে শোনাবো আমার সকল পূর্ণতা-অপূর্ণতার গল্প।

 

প্রকাশিত পত্রিকাঃ রাইজিংবিডি .কম।
প্রকাশকালঃ ২০ মার্চ, ২০২২
ই-পেপার লিঙ্কঃ https://www.risingbd.com/campus/news/450740

প্রকাশিত পত্রিকাঃ দৈনিক খোলা কাগজ।
প্রকাশকালঃ ২৪ মার্চ, ২০২২
ই-পেপার লিঙ্কঃ http://ekholakagoj.com/epaper/edition/1521/kholakagoj/page/5

FB IMG 1691997872636