পথশিশু পথ খুঁজে পাবে কবে?


আশিকুর রহমান প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৫, ২০২৩, ৬:৪৪ অপরাহ্ণ /
পথশিশু পথ খুঁজে পাবে কবে?

আশিকুর রহমান: ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। কথাটির মর্মার্থ- আজকের শিশু, কিশোররাই আগামী দিনের পিতা। আজকের শিশুরাই ভবিষ্যৎ জাতির কাণ্ডারি, ভবিষ্যৎ কর্ণধার। শিশুরা নিষ্পাপ, এরা পরিবার ও রাষ্ট্রের ফুল। কিন্তু বাগানের ফুল অবহেলায়, অযত্নে ঝরে গেলে সেই বাগানের সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা শিশু, কিশোর তথা বর্তমান প্রজন্মের দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়। শিশুদের মধ্যে রয়েছে অপার সম্ভাবনা, যা শিশু কিংবা কৈশোরে উদ্দীপ্ত থাকে। শিশুর এ উদ্দীপ্তই দেশকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। যারা এই দেশকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরবে তারাই যদি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কেমন হবে তা নিয়ে উদ্রেক নেই কারো।২ অক্টোবর সুবিধা বঞ্চিত শিশু দিবস। প্রতিবছর এই দিনটি বক্তব্য, ব্যানার, ফেস্টুন, র‌্যালি ও জাঁকজমকভাবে পালন করা হলেও বাস্তবায়নের দিকে নজর নেই বললেই চলে। সমাজের আনাচেকানাচে অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত শিশু রয়েছে যারা দিনে এক বেলা খাবার খেতে পারেনা। পেটের দায়ে ঘুরতে হয় রাস্তায় রাস্তায়। যাদের নির্দিষ্ট কোন বাসস্থান নেই। যে বয়সে তার মায়ের হাতের রান্না খেয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা সেই বয়সে ফুটপাতে বেড়িয়ে পড়ছে খাবারের খোজে। অনেকে শহরের ফুটপাতে ফুল বিক্রি করে, চা বিক্রি করে, রেলস্টেশনে হকারী করে। অনেকে আবার শ্রমিক, রিকশাচালিয়ে খাদ্যের সন্ধানে নেমে পড়ে। আবার অনেক শিশুই খাবারের জন্য ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নেয়। এসব অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দিয়ে সমাজের অসাধু লোকেরা অপরাধ করায়। তারা এক বেলা খাবারের জন্য যেকোন অন্যায় পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়। নির্দিষ্ট বাসস্থান না থাকায় শহরের অলিতে-গলিতে, বস্তি কিংবা রেলস্টেশনকে বেছে নেয় ঘুমানোর জন্য। এতে মেয়ে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে হরহামেশায়। অনেকে আবার রাতের অন্ধকারে শহরের ফুটপাতগুলোতে অর্থ উপার্জনের পথ হিসেবে বেছে নেয় নিষিদ্ধ কাজ।
সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩৪, ৩৭,৩৮, ৩৯, ৪০,৪১ এ সকল নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ করে অনুচ্ছেদ ২৮(৪) এ শিশুদের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ বিধান প্রণয়ন করার বিষয় সন্নিবেশিত রয়েছে। কিন্তু মৌলিক অধিকারগুলোর এক ছিটেফোঁটা সুবিধা পাচ্ছেনা এই শিশুরা। খাদ্যের সন্ধানে যখন তাদের এই নাজেহাল অবস্থা তখন অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বিলাসিতা মাত্র। তারা পাচ্ছেনা প্রয়োজনীয় বস্ত্র, যথোপযুক্ত চিকিৎসা। শিক্ষা লাভের অধিকার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। কিন্তু অভিভাবকহীন এই শিশুরা শিক্ষার বদৌলতে খাদ্যের সন্ধানে হাতে তুলে নিচ্ছে ইট ভাঙ্গার হাতুড়ি। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন ২০১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সব ধরনের নিষ্ঠুরতা, জোর-জবরদস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে দুঘর্টনার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যার ফলে তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এমন ধরনের কাজ থেকে শিশুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। যেসব কাজ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং যে কাজ তার শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেসব কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারও শিশুর রয়েছে।
জাতিসংঘ সনদ ও বাংলাদেশ সরকারের শিশু নীতি অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সের ব্যক্তিকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ ভাগ শিশু, এর মধ্যে ১৫ শতাংশ সুবিধাবঞ্চিত শিশু। সুবিধা বঞ্চিত শিশুর সংখ্যার যথাযথ কোন জরীপ না থাকলেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১০-১৫ লাখের অধিক পথশিশু রয়েছে। যারা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এছাড়াও ২০০৫ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক গবেষনা অনুযায়ী, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর জায়গা নেই, ৪০ শতাংশ প্রতিদিন গোসল করতে পারেনা, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় পায়খানা করে এবং ৫৪ শতাংশ শিশুর অসুস্থতায় দেখার কেউ নেই। পথশিশুদের এমন করুন অবস্থা দেশ পিছিয়ে থাকারই বহিঃপ্রকাশ। শিশু অধিকার ফোরামের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাদকাসক্ত পথশিশু ৮৫ শতাংশ, হেরোইন ১৯ শতাংশ, ধুমপানকৃত ৪৪ শতাংশ, ট্যাবলেটে আসক্ত ২৮ শতাংশ, ইনজেকশনে আসক্ত ৮ শতাংশ। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ, মেয়ে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ৪৬ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে যৌন শিকারের শিকার হয় প্রায় ১৪.৫ শতাংশ পথশিশু। এছাড়াও জীবন টিকিয়ে রাখতে কাজ করে প্রায় ৮০ শতাংশ পথশিশু। বাংলাদেশকে ডিজিটালাইজড করার লক্ষ্যে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর অধিকার রক্ষার বিষয়টি জড়িত। বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে পথশিশুদের অধিকার রক্ষা প্রয়োজন। দেশে পথশিশুর সংখ্যা হ্রাসই নয়, বরং নির্মূল করতে না পারলে দেশের সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। পথশিশুরা সমাজে উপেক্ষিত, সকল সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত। অন্যান্য সকল স্বাভাবিক শিশুর মতই পথশিশুদের সমাজে বেড়ে ওঠার অধিকার রয়েছে কিন্তু তারা সমাজের সুস্থ পরিবেশ থেকে দূরে। প্রাথমিক শিক্ষাটুকুও পায়না। পথশিশুদের যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সেখানে শিক্ষার আলো নয় বরং রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলোই তাদের বিলাসিতা। তবে এদের শিক্ষার আগে খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থার প্রয়োজন। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পুলিশের তথ্য বলছে, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেশে ১১ লাখ পথশিশু কিছু না কিছু অপরাধে জড়িত। তাদের প্রায় অর্ধেক মাদকাসক্ত। পুনর্বাসন না করলে এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর সংগঠন স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাকটিভিস্টস নেটওয়ার্ক-স্ক্যানসহ বিভিন্ন সংগঠন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অভিক্ষেপণের ভিত্তিতে জানায়, সারা দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি।

বাংলাদেশে পথশিশু সংখ্যা যাই হোক না কেন তা দেশের প্রকৃত উন্নয়নের অন্তরায়। একটা বিরাট অংশ যদি অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে তাহলে দেশের প্রকৃত অগ্রগতি ধীর গতির হবে। আমাদের দেশে অনেকেই পথশিশুদের ঈদের সময়, শিশু দিবস কিংবা কোন বিশেষ দিনে নতুন পোশাক কিনে দেয়, কেউ আর্থিক সাহায্য করে। কেউ কেউ পথশিশুদের জন্য স্কুল খুলে তাদের প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছে কিন্তু এসব পদক্ষেপ পথশিশুদের দীর্ঘ মেয়াদে কোনো উপকার করে না। যথাযথভাবে পুনর্বাসন না হওয়ায় তারা আবার আগের জীবনেই ফিরে যায়। উন্নত দেশগুলোয় দেখা যায়, প্রত্যেক শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্র কোনো না কোনোভাবে পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো এটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই পথশিশুদের অধিকার নিশ্চিতে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, পথশিশুদের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরী। সমাজের সকল স্তরের লোকের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদেরকে সমতা, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা শেখাতে সমাজের সবার এগিয়ে আসতে হবে। পথশিশুদের নিয়ে সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে, এদের স্থায়ী পুনর্বাসনে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। এদের খাদ্য ও বাসস্থান নিশ্চিত কল্পে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে পথশিশুদের খাদ্য, বাসস্থান, যথাযথ সুরক্ষার অধিকার, পুষ্টির অধিকার ও শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

প্রকাশিত: দ্বিমাসিক ডাকঘর (৬ষ্ঠ সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রবন্ধ)

FB IMG 1692102911458

বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন বিভাগের আরো খবর

আরও খবর