অর্থনীতিতে জ্বালানি মূল্যস্ফীতির প্রভাব


আশিকুর রহমান প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৫, ২০২৩, ৭:৩৩ অপরাহ্ণ /
অর্থনীতিতে জ্বালানি মূল্যস্ফীতির প্রভাব

আশিকুর রহমান: জ্বালানি তেল শুধু বিশেষ কোন খাত নয় বরং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে বহুলাংশে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কিছুটা কমে এলেও সরকার দেশে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেনের ৪২.৫ শতাংশ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধি আপামর জনগণের পাশাপাশি অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। কেননা পরিবহণ ব্যয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। কারন জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সরাসরি জনস্বার্থ তথা ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামগ্রিক অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত। জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের প্রধানতম রপ্তানিখাত নিট সেক্টরসহ দেশের সামগ্রিক শিল্পখাতে মারাত্মক বিরুপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের এই কঠিন সময়ে শিল্প কারখানার জ্বালানির উপর নির্ভর সকল কর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টির ফলে রপ্তানি আয় কমে আসবে। বিশেষ করে ডিজেল, অকটেনের মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যুৎ, পরিবহণসহ দেশের সকল উপখাতগুলোতে প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে বিকেএমইএ। বিকেএমইএ-এর দাবি, কিছুদিন ধরে কারখানাগুলোতে গ্যাসের সরবরাহ ঠিক মত হচ্ছেনা। এটি উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত করছে যা, উদ্যোক্তাদের ব্যাপক চাপে ফেলবে। ফলে বিশ্ববাজারে রপ্তানির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে ফলে শিল্পখাতে জ্বালানির এই অস্বাভাবিক দাম ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধি শিল্পখাতে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহণ ব্যয় আরো বাড়িয়ে দেবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যয় বাড়বে, পণ্যের দামও বৃদ্ধি পেতে পারে ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়বে এবং স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। এভাবে চলতে থাকেে দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

দীর্ঘ করোনা মহামারির নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে অর্থনীতি যখন স্বাভাবিকতা হওয়ার পথে ঠিক সে সময়ে গত ৫ আগষ্ট সরকার কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই জ্বালানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন যা সরাসরি সকল পরিবহণ খাতে প্রভাব ফেলবে। সরকারের সংস্থা বিবিএসের তথ্য বলছে, গত একবছরে মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহণ ব্যায় বেড়েছে ৯১ শতাংশ। তেলের দাম বাড়ার পর থেকেই পরিবহনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। বহু স্থানে পরিবহণ বন্ধ রেখেছে মালিকপক্ষ। এতে গনপরিবহনে ভাড়া বাড়বে এবং জনসাধারণের উপর যেমন বিরুপ প্রভাব পড়বে তেমনি পরিবহণ খাতের অর্থে ব্যাঘাত ঘটবে এবং জনসাধারণকে গুনতে হবে দ্বিগুণ ভাড়া। এতে জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসবে এবং পরিবহণ খাতে ফরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এছাড়াও বর্তমানে আমদানিকৃত জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এখন তা উল্লেখযোগ্যহারে বহুলাংশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে।

জ্বালানি তেলের বাজারমূল্য বৃদ্ধি কৃষির উৎপাদনে বড় রকমের প্রভাব ফেলবে। এ বছর বন্যা, অতিবৃষ্টি ও খরার ফলে ব্যাপক ফসলহানি ঘটেছে। তার ওপর ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে কৃষির নিত্য ব্যবহার্যসহ সকল কৃষি পণ্যের দাম উর্ধ্বমূখী। গত ১ আগষ্ট ইউরিয়া সারের দাম কেজি প্রতি বাড়ানো হয় ৬ টাকা যার ধাক্কা কাটতে না কাটতেই গত শুক্রবার (৫ আগষ্ট রাত ১২ টার পর) লিটার প্রতি ডিজেল ৩৪ টাকা, কেরোসিন ৩৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা ও পেট্রোলের দাম বাড়ানো হয় ৪৪ টাকা যা, সরাসরি প্রভাব ফেলবে সেচকাজে। এমন অবস্থায় উৎপাদন ধরে রাখতে দিশেহারা কৃষকরা। জলবায়ু পরিবর্তনের এমন বিরুপ প্রভাবের মধ্যে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি যেন মরার উপর খারার খা। বিশেষজ্ঞরা বলছে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারনে সামনের বোরো ও রবিশস্য আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারন মোট বার্ষিক ধান উৎপাদনের ৬০ শতাংশই বোরো, যা মূলত সেচনির্ভর। দেশে সেচযন্ত্রের সংখ্যা ১৬ লাখ ১০ হাজার এর মধ্যে ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডিজেল চালিত। বাকি ২ লাখ ৭০ হাজার চলে বিদ্যুতে। কৃষির উৎপাদনে প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যায় বৃদ্ধি পাবে যেক্ষেত্রে উৎপাদনে বিরুপ প্রভাব পড়বে এবং উৎপাদন কমে যাবে। অথচ এই খাত আমাদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখে থাকে।
জ্বালানির এই মূল্য বৃদ্ধি জনসাধারণের জীবনকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করবে কেননা, বিগত জ্বালানির সাথে তাল মিলিয়ে বাড়েনি চাকরিজীবী ও কর্মচারীদের বেতন। তার ওপর করোনা মহামারিতে বেড়েছে দরিদ্রের হার। এই মূল্যমান তাদের চলমান অভাব ও দুঃখ-কষ্টকে বাড়িয়ে দেবে। মানুষের জীবনযাত্রায় যেমন ব্যয় বাড়ে তেমনি স্বাভাবিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপরও এর প্রভাব পড়বে। উদ্যোক্তারা নিজেদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিজেদের খরচ সমন্বয় করলেও এর ভুক্তভোগী হবে সাধারণ জনগণ। এর অর্থ দাড়ায় জ্বালানির দাম বৃদ্ধির খেসারত দিতে হবে প্রান্তিক জনগণ ও ক্রেতা-ভোক্তাদের। খাত সংশ্লিষ্টদের দাবি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি শুধু একটি পণ্যের দামের সাথে সম্পর্কিত নয় বরং এর সঙ্গে পরিবহণ, ঔষধ শিল্প, নির্মাণ শিল্প, পোশাক শিল্প, সব ধরণের খাদ্যদ্রব্য সামগ্রীসহ রপ্তানিমুখি শিল্প খাতের ভোক্তা ও ব্যবহারকারী সম্পর্কিত। অর্থাৎ নিম্ন থেকে শুরু করে উচ্চস্তর সকল পর্যায়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলবে।
বর্তমানে দেশে জ্বালানি মজুদের যে ক্ষমতা তা আরো দীর্ঘায়িত করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত কল্পে একটি দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে জ্বালানি উত্তোলন করতে হবে। এছাড়া দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে যে কোন অবস্থাতেই স্থানীয় বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি হ্রাস করার কোন বিকল্প নেই।

 

প্রকাশিত: দৈনিক ইত্তেফাক
প্রকাশকাল: ৯ আগস্ট, ২০২২
লিংক: https://shorturl.at/ajIW0

FB IMG 1692105925399