অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নতুন দ্বার


আশিকুর রহমান প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৫, ২০২৩, ৭:২৩ অপরাহ্ণ /
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নতুন দ্বার

আশিকুর রহমান: পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আমরা এক সম্ভাবনার নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করলাম। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্যে বারবার এসেছে বাংলাদেশের এই প্রধানতম নদী পদ্মা। পদ্মা নামটি এসেছে লোটাস ফুল থেকে। পদ্মার উৎপত্তী হিমালয়ের গঙ্গোত্রি পাদদেশের হিমপ্রবাহ থেকে। পদ্মা নাম শুনলেই দেশের মানুষের মনে ভেসে উঠত সেই দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ভোগান্তির চিত্র। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা, ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষি, শিল্পসহ সর্বক্ষেত্রে দুর্ভোগের এক নাম ছিল পদ্মা। এই পদ্মাকে ঘিরেই রচিত হয়েছে কত কবিতা, গান, রচনা। আর আজ পদ্মার বুকে রচিত হলো বাংলার ইতিহাসের বিস্ময়কর ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’। খুলে গেল অপার এক সম্ভাবনার দ্বার। পদ্মা সেতু, আজ সকল বাংলাদেশির সাহসিকতার আরেক নাম। পদ্মা বহুমুখী সেতুর ভিত্তি হয়েছিল আঠারো বছর আগে। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসন ঘটিয়ে ২৫ জুন বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস প্রচেষ্টায় সফলভাবে উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনে অংশ নিয়ে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘পদ্মা সেতু শুধু ইট পাথরের অবকাঠামো নয়, এটা আমাদের অহংকার ও সক্ষমতার প্রতীক’। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে এই পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে কাঠখড় পোহাতে হয়েছে বাংলাদেশের। পাড়ি দিতে হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বাঁধাগ্রস্ত করেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে ও কঠিন চ্যালেঞ্জে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু আজ বাংলার মানুষের কাছে ইতিহাসে বিস্ময়। আজ এ শুধু কল্পনা নয়, বহুল প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তবে ধরা দিয়েছে বাংলার মানুষের কাছে। এ যেন বাংলাদেশের আরেক জয়। এটি শুধু একটি সেতু-ই নয়, এটি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের চালিকাশক্তি, সক্ষমতার প্রতীক। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষসহ সারা বাংলার মানুষের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন ছিল এই সেতু, ছিল বুকভরা প্রত্যাশা। আজ তা বর্তমান ও বাস্তবিক। দেশের মানুষের সাহস আর অদম্য মানসিকতার দৃঢ় প্রতীক। বিশ্বব্যাংক কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাংলাদেশ যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে এটাই তার অন্যতম প্রমাণ। কারো কাছে মাথা অবনত না করে আত্মমর্যাদায় মহিয়ান হয়ে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলার মানুষের স্বপ্ন পূরন হয়েছে, জয় হয়েছে মানুষের আস্থার। অবশেষে কল্পিত স্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে এখন স্বাধীন দেশের স্বনির্ভরতার প্রতীক এই পদ্মা সেতু। এই সেতুর অর্থায়ন করেছে দেশের সর্বস্তরের জনগণ, নিতান্তই এই সেতুর মালিক জনগণ। দেশের মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষমতা ও চ্যালেঞ্জের যে মধ্যকার সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে তার গৌরব ও অহংকার নিতান্তই সর্বস্তরের জনগণের। একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নীতকরণ। যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি হলে রাষ্ট্রের যোগান সঠিক ভাবে, সঠিক সময়ে হয়না। এতে রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় হয়। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাজধানীসহ দেশের ২১টি জেলার সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করেছে; যা ঐ সকল জেলার যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তরান্বিত করবে। এই সেতুর নিচ দিয়ে রেল সংযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। এমন কয়েকটি জেলার সাথে রেল যোগাযোগ স্থাপন করেছে যেসব জেলার সাথে পূর্বে রেল যোগাযোগ ছিল না। সরাসরি সড়ক পথ ও রেল সংযোগের ফলে এসব জেলায় তৈরি হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, শিল্পকারখানাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে, ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত হবে। পূর্বের তুলনায় যাতায়াত ব্যবস্থায় এখন ৩-৪ ঘণ্টা সময় কম লাগবে। ফলে বাংলাদেশ দ্রুতগতির উন্নয়নে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে। এতে দেশে স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) মাত্রা ১.২ হতে ১.৫ এ উন্নীত করবে। অপরদিকে স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে ২.৩ শতাংশ। এখন পুনরুদ্ধার করা লবণাক্ত জমি উর্বর হতে শুরু করবে, ফসলের ফলন বৃদ্ধি পাবে। মৎস শিল্পসহ সকল প্রকার হিমায়িত পণ্যদ্রব্য আর হিমায়িত নয় বরং স্বল্প সময়ে বাজারজাত করনে আয় বাড়বে বহুগুণ। সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে এখন কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, খুলনা, মোংলায় পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এতে যেমন মানুষ কম সময়ে পর্যটন কেন্দ্রে পৌঁছাবে তেমনি পরিবহণ ব্যয় বহুলাংশে কমবে। পর্যটন এরিয়ার স্থানীয় নিঃস্ব ও নিম্নবিত্ত মানুষের উপার্জন ক্ষমতা বেড়ে যাবে ঠিক ততগুনে পর্যটন শিল্পের সমৃদ্ধি হবে। এতে ঘটবে ব্যাপক শিল্পায়ন ও বছরের শুরুতে দারিদ্র হ্রাস পাবে আনুমানিক ০.৭৫ শতাংশ। পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় তিন কোটির ও বেশি মানুষ। এতে কর্মসংস্থান, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পিছিয়ে থাকা জেলা গুলোর উন্নয়নের মধ্য দিয়ে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দরিদ্রতা কমবে। একদিকে যেমন যাতায়াতের সময় কমে আসবে অন্যদিকে পরিবহণ খরচ ও কমবে এই সেতুর কল্যাণে। এখন আর চিকিৎসার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে থাকতে হবেনা ফেরীঘাটে, চাকুরীজীবী মানুষটাকে আর দেরিতে অফিসে যাওয়ায় মিথ্যা অজুহাত দেখাতে হবেনা। ফেরি বা নৌযানে বহন করা কষ্টসাধ্য পন্য এখন সহজেই রেলে বাজারজাতকরন ও ভোক্তাদের কাছে বিপণন করা যাবে। ফলে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করে বাজারের মূল্য স্থিতিশীল থাকবে। এতে যেমন জাতীয় অর্থনীতি ও আঞ্চলিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে তেমনি ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
পদ্মা সেতু শুধু স্থানীয়ভাবে নয়, এটি আন্তর্জাতিক ভাবেও গুরুত্বপূর্ন। কেননা পদ্মা সেতু ও সরাসরি সংযোগ সড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রুট এএইচ-১ এর অংশ হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ সহজ করবে। ভারত, নেপাল ও ভূটানের সাথে সরাসরি সংযোগ করে চলাচলে যেমন সহজ হবে ঠিক ততটাই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটি আর্থ-সামাজিক অবদান রাখার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ কে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচয় দিবে।
সর্বোপরি, দক্ষিণাঞ্চলের ২১ টি জেলার মানুষের ব্যবসা, শিক্ষা, শিল্প ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সঙ্গী হয়ে থাকবে। পদ্মা সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা নয়, বরং অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। পদ্মা সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের আত্মপরিচয়।

 

প্রকাশিত: দৈনিক ইত্তেফাক
প্রকাশকাল: ২৮ জুন, ২০২২
লিংক: https://epaper.ittefaq.com.bd/

FB IMG 1692105354489