তারুণ্যের অনির্বাণ শিখা বঙ্গবন্ধু
অনিল মো. মোমিন: শতবছরের শৃঙ্খল ভেঙে ‘যেমন ইচ্ছে লেখা আমার কবিতার খাতা’র মতো একটি নিজেদের ভূখণ্ড পেতে বহু সংগ্রামের পথ পেঁরিয়ে চূড়ান্ত মুক্তিতে পৌঁছাতে এদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধিকার আন্দোলনের রয়েছে এক গৌরবময় ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পাতায় ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করা এক নক্ষত্রের নাম বঙ্গবন্ধু। যিনি আমৃত্যু স্বপ্ন দেখেছেন ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও ন্যায়-সাম্যের এক দেশের। যেদেশে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, গোষ্ঠী বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি শোষণ-বৈষম্য করা হবে না। সেই স্বপ্নে বিভোর বাঙালি সংস্কৃতি ও দেশপ্রেমে বলীয়ান মধুমতিপারের ছোট্ট খোকা বিশ্বের বুকে এমন এক মহান দেশের জন্ম দেন যার উন্নয়ন, অগ্রগতি আর অর্জনে বিশ্ব এখন অবাক তাকিয়ে রয়। খোকা থেকে শেখ মুজিব, মুজিব ভাই, এরপর বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা কিংবা জাতির পিতা থেকে বিশ্ব নেতা হয়ে ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ বনে যাওয়া মানুষটির সীমাহীন ত্যাগ,অক্লান্ত সংগ্রাম, দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও সঠিক নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। এভাবে বাঙালি, বাংলা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শব্দগুচ্ছ একই সূত্রে গাঁথা। তাই বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু।
মহানায়কের বর্ণাঢ্য জীবন যুগ-যুগান্তরে দেশ, জাতি, ধর্ম-বর্ণ, রাজনীতিসহ সর্বত্র এক অনুকরণীয় আদর্শ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি এক অনির্বাণ আলোক শিখা। ত্যাগ-তিতিক্ষা, মহানুভবতা, ন্যায়, সাম্য ,অসাম্প্রদায়িকতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নেতৃত্ব ও মানুষের জন্য রাজনীতির এক অনন্য সমন্বয় বঙ্গবন্ধু। যার প্রতিটা পরতে পরতে তরুণদের পথচলার দিকনির্দেশনা আর এগিয়ে চলার প্রেরণা রয়েছে। বাল্যকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু মানুষের কল্যাণকামী ছিলেন।
একবার স্কুল থেকে আসার সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। গরীব বন্ধুর ছাতা না থাকায় তাকে ছাতাটি দিয়ে নিজে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িতে যান। আবার শীতের দিনে রাস্তায় এক অসহায় বৃদ্ধ শীতে কাঁপছে বলে নিজের গায়ের চাদরটি দিয়ে দেন। শৈশবের এই ঘটনা থেকে শেখ মুজিবের ত্যাগ ও পরোপকারীতার শিক্ষা পাওয়া যায় যা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চর্চা করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্পষ্টভাষী। ১৯৪৪ সালে বঙ্গবন্ধু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ছাত্রলীগে কাজ করতেন। এক মিটিংয়ে শহীদ সাহেবের এক প্রস্তাব পছন্দ না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু অমত করলে শহীদ সাহেব রেগে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘Who are you? You are nobody.’ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘If I am nobody then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody.(অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।
সারাজীবন নিজকে দেশ ও মানুষের সেবায় উৎসর্গ করা নির্মোহ মানুষটি ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য তাঁর যে দীর্ঘ সংগ্রাম ও সাধনা, তার কোনো তুলনা নেই। যা এসময়ের রাজনীতির সাথে যুক্ত তরুণদের বড় শিক্ষা। আবার সাহসিকতা ছিল বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না’, কিংবা ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আমি বলব, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা।’ হার না মানা অকুতোভয় নায়কের পরিচয় বহন করে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করেছেন, ‘এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছেন, তরুণদের শিক্ষা রয়েছে তা বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে দেশের সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করতে আমাদের দায়িত্ব— নিজের প্রত্যেকটি কাজ সততা ও নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের হাতিয়ার হওয়া। শোষণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।’ নারীদের কিভাবে মূল্যায়ণ করতে হয় তরুণরা তা শিখতে পারে বঙ্গবন্ধু থেকে। মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর সহমর্মিতা ও সহানুভূতির সমন্বয়ে যে মহানুভবতা দেখিয়েছেন তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। তিনি বীরাঙ্গনাদের সবার বাবার পরিচয় হিসেবে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নামটি লিখতে বলেছিলেন। একজন নারীর প্রতি তাঁর এই যে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তা সর্বদা অনুকরণীয়।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধুর মানুষের প্রতি স্বার্থহীন ভালোবাসা, সাহসিকতা কিংবা তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, বাগ্মিতা তরুণদের সবসময়ে সহজেই আকৃষ্ট করেছে, করছে ও ভবিষ্যত করবে। ৭ই মার্চের ভাষণ কালান্তরে প্রতিটি তরুণ হৃদয়ে সাহস, প্রতিবাদ, নতুন স্বপ্ন, ও মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ের বিষ্ফোরণ ঘটায়। এ শিক্ষা থেকেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, গণজাগরণ মঞ্চ, কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সংগঠিত ও হয়েছিল। এভাবে যতদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আঁকড়ে ধরে চলবে ততোদিন পথ হারাবে না বাংলাদেশ। কেননা ভ্রাতৃত্ববোধের মর্মবাণী, নিজ নিজ অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়া, সুস্থভাবে বাঁচার দাবি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, দেশরক্ষার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মতো শিক্ষা আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকেই পাই। উদার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শোষণহীন সমাজ গড়ার শিক্ষাও তরুণরা বঙ্গবন্ধু থেকেই পাচ্ছে। তারুণ্যের চেতনায় ও অনুপ্রেরণায় বঙ্গবন্ধু যুগে যুগে আদর্শ, ন্যায়পরায়ণতা, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন, থাকবেন।
প্রকাশিত: দৈনিক ইত্তেফাক
প্রকাশের তারিখ: ১৫ আগস্ট ২০২১
ইপেপার লিঙ্ক: https://epaper.ittefaq.com.bd/2021/08/15/images/27_102.jpg?v=1.0.1
আপনার মতামত লিখুন :