কচুরিপানাতত্ত্ব ও আমরা
অনিল মো. মোমিন : বহুল প্রচলিত কথা বাঙালি হুজুগে জাতি। সময়ের সাথে আমরা পরিবর্তন হয়েছি, হচ্ছি কিন্তু চরিত্র পুরোপুরি পরিবর্তন করতে পারিনি এখনো। আমাদের মস্তিষ্ককে এখনো অলস রেখেই আমরা তা ব্যবহার করি। আরো সহজ করে বললে আমরা আসলে জাতি হিসেবেই না বুঝে লাফানোর স্বভাবটা লালন করে চলেছি। অথচ আমরা যদি মস্তিষ্ক টা ব্যবহার করে চিন্তা বা সমালোচনা করি তবে অহেতুক অনেক কিছু ভাইরাল হয় না। পরিকল্পনামন্ত্রী সেদিন গবেষণার গুরুত্ব বুঝাতে মজার ছলে বলেছেন, ‘কচুরিপানা কি কোনভাবে খাওয়া যায়না? আমি গ্রামের ছেলে;..’ পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন গরু খায় তখন মন্ত্রী হাসতে হাসতেই বললেন, ‘গরু যদি খেতে পারে, আমরা কেন পারবোনা?’
মূলত কচুরিপানা কোনভাবে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা যাবে কি না এই ব্যাপারে গবেষণা করে যেতে হবে। গবেষণার উপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করতেই মজা হিসেবে কথাটা বলেছেন। অথচ সংবাদমাধ্যমগুলো বেশি বেশি মিডিয়া কাভারেজ পেতে জনগণকে আকর্ষণ করার জন্য হেডলাইন করলেন মন্ত্রী কচুরিপানা খেতে বললেন।
একাত্তর টিভির এক সচিত্র প্রতিবেদন থেকে জেনেছি বরিশালের আগৈলজঝাড়ায় এক নারী কচুরিপানা ব্যবহার করে পেপার, রঙ্গিন পেপার, বিভিন্ন ধরনের কার্ড ইত্যাদি তৈরি করছেন হচ্ছে খুব সহজেই। এটা করে তিনি এখন স্বাবলম্বী। তার দেখাদেখি অনেক মহিলাও এগিয়ে এসেছে। ফলে মানুষের কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছে সেই এলাকায়। কচুরিপনার ফুলের পাকোড়া খেয়েছেন বলে এক লেখক ও সাংবাদিক তার লেখায় জানিয়েছেন। কম্বোডিয়ায় শোলমাছের সাথে কচুরিপানা খাওয়া হয় বলে শুনেছি।এসব ছাড়াও কচুরিপানার বহু ব্যবহার কমবেশি সবাই জানেন।
গবেষণার মাধ্যমে যদি এটা খাওয়ার উপযুক্ত করা যায় তবে মন্দ কী? বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জাতীয় সংসদে যথার্থই বলেছেন, “প্রতিদিন নতুন নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন আসছে। আগে মাশরুম দেখলে বলা হতো ব্যাঙের ছাতা, নিষিদ্ধ খাবার। এখন তা খাওয়া হচ্ছে। হয়তো এমন দিন আসবে, কচুরিপানা থেকেও খাবার আবিষ্কৃত হবে।” ছোটবেলা ব্যাঙের ছাতা ভেবে মাশরুমের কাছে যেতেও ঘেন্না লাগতো আর এখন এটা উপাদেয় দামী খাবার। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য থেকে আরো জানলাম পাট থেকে তৈরি হচ্ছে উন্নত চা।
বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় খাদ্য যোগানে নতুন নতুন গবেষণার প্রয়োজন আছে। প্রকৃতিতে কোন কিছুই সৃষ্টিকর্তা এমনি এমনি দেননি। বিশ্বে এখন খাদ্য সংকট প্রকটই বলা যায়। চায়নাদের খাদ্য তালিকায় দেখলাম জীবজন্তুও কাছে। বাংলাদেশেও কচ্ছপ আর কুচে খাওয়া হয় বলে কমবেশি সবাই জানি। অতএব পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করার কিছু নেই। সেটা যুক্তিবিদ্যার আলোকে বলেন কিংবা সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বলেন। তাই বিকল্প খাদ্যের খোঁজে গবেষণার বিকল্প নেই।
সেই গবেষণা সফল হোক বা না হোক সফল হতে হবে আমাদের কমনসেন্সের। জাতি হিসেবে সচেতন হওয়া খুব জরুরি। আমাদের চিন্তার প্রসারতা বাড়াতে হবে। বিশ্লেষণ না করে কোন কিছু ভাইরাল করে দেয়ার ভেতর কোন কৃতিত্ব নেই। হুজুগে জাতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সাধারণ মানুষরদের এসব ব্যাপারে বিচার বিবেচনাবোধ কম হলেও শিক্ষিতরা চিন্তা ভাবনার চর্চা করতে হবে। কিন্তু দুংখজনক হলেও সত্যি শিক্ষিতদের ভিতর এসব বিবেচনাবোধের লক্ষণ লোপ পাচ্ছে। সংসদে দাঁড়িয়েও স্বল্পবুদ্ধির পরিচয় দিতে দেখেছি (পরিকল্পনামন্ত্রীর জন্য সংসদে কচুরিপানা নিয়ে গিয়েছিলেন)।
আজকাল দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এসব বোধের চর্চা করে না। যা পায় তাই নিয়ে মেতে উঠে,ভাইরাল করে, ট্রোল করে। এভাবে চলতে থাকলে না জানি কবে আরেকটা বিশেষনের অধিকারী হয়ে যাই; ভাইরাল জাতি। সংবাদমাধ্যমগুলোকেও হেডলাইন তৈরিতে আরো সচেতন হওয়া জরুরি।
ইদানিং এমনভাবে হেডলাইন প্রকাশ করে যেখানে অনেক ক্ষেত্রে মূল কথাই খুঁজে পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ে। মানুষের মনস্তত্বকে উসকে দেয় এমন শিরোনাম না হওয়াই উচিত। কারণ শিরোনাম দেখেই লোকজন প্রতিক্রিয়া শুরু করে দেয়; পুরো নিউজ কমই পড়ে। জনগনকে আকর্ষিত করার চেয়ে সংবাদপত্রের নৈতিকতার চর্চা বেশি প্রয়োজন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।
আমাদের শুভবুদ্ধি ও চিন্তাভাবনার উদয় হোক।
প্রকাশিত: বাংলাদেশের খবর
প্রকাশকাল: ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
ইপেপার লিঙ্ক: http://epaper.bangladesherkhabor.net//images/26_02_2020/regular_10437_news_1582639764.jpg
ইপেপার কাটিং
আপনার মতামত লিখুন :