প্ল্যাটফর্মে একটি শীতের রাত
মামুন মিসবাহ: মধ্যরাত। কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ। মাঝেমধ্যে হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ঘাড়ব্যাগটা কোলে চেপে জুবুথুবু হয়ে বসে আছি প্ল্যাটফর্মে। মোজা না থাকায় দুটি পা যেন দুই খণ্ড বরফ প্রায়। সঙ্গীহীন একাকী অপেক্ষার রাত যেন শেষই হচ্ছে না। রাত যত গভীর হচ্ছে বাড়ছে তত জনশূন্যতা। একটু আগেও স্টেশনে ছিল মানুষের সমাগম। ট্রেনের জন্য যাত্রীদের অধীর আগ্রহ। স্টেশনগেটে টিটিদের টিকিট চেক-অভিযান। হঠাৎই নীরব হয়ে গেল সব। থেমে গেল ব্যস্ততার দৌড়। দেখা নেই প্ল্যাটফর্মে কোনো ট্রেনের। এখন শুধু প্ল্যাটফর্মজুড়ে নীরবতার আচলে ঢাকা অপ্রত্যাশিত খানিকের শূন্যতা।
প্রায় ছয় মাস পরে বাড়িতে যাচ্ছি। সেই যে কোরবানির ঈদে গিয়েছি! আর যাওয়া হয়নি। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার টেনশনে বাড়ির কথা ভুলেই বসেছিলাম। সেদিনও কেন যেন মনে হচ্ছিল; এই তো কদিন হলো বাড়ি থেকে আসলাম। অথচ কেটে গেছে পাঁচ মাস। সেদিকে খেয়ালই ছিল না। আজ বাড়ির দিকে ছুটছি। মনজুড়ে টুকরো খুশির আমেজ। পরীক্ষা শেষে শীতের লম্বা একটা ছুটি। বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সবার সঙ্গে সময় কাটবে আনন্দণ্ডউল্লাসে। এই অনুভবগুলো মনে থাকলেও ট্রেনের অপেক্ষা যেন সব শেষ করে দিচ্ছে। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। শেষই হচ্ছে না। দুই ঘণ্টা লেট করে আসছে ট্রেন। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত ৩টা বেজে যাবে মনে হচ্ছে। সময় যেন আজ কচ্ছপের গতিতে চলছে। মানজিল তো জানা কিন্তু; পৌঁছাব কখন; সেটা জানা নেই। সময় কাটানোর জন্য ইয়ারফোন কানে দিয়ে কিছুক্ষণ সংগীত শুনলাম। তাতেও ছিল না মন। অপলক দৃষ্টিতে দুটি চোখ কিছু দেখছিল। ঠিক আমার মতো চারচোখা ছোট্ট একটি মেয়ের দুষ্টুমি। মোবাইল নিয়ে তার এদিক-ওদিক ছোটাছুটি। কখনো দৌড়ে এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া। আবার কখনো কিছু কিনে নেওয়ার নানারূপ বায়না। এ যেন এক শৈশবের দুরন্তপনা। ভাবতে গেলেই মনে পড়ে যায় নিজের কাটানো শৈশবের স্মৃতিগুলো। কতটা দুষ্টু ছিলাম। আহ! জ্বালিয়ে খেতাম আম্মুকে। এটা দাও, ওটা দাও বলে কিযে বায়না ধরতাম। না পেলে তো কখনো কখনো মাটিতে পড়ে গড়াগড়িও করতাম। সবই এখন স্মৃতি। নতুন অধ্যায়ে জীবন চলছে আপন গতিতে। শৈশব-কৈশোর শেষে এখন যৌবনের সাময়িক চলতি পথে। হয়তো এক দিন সেটাও শেষ হয়ে যাবে। সফেদের আগমনে পাড়ি জমাব শিশুতুল্য বৃদ্ধকালের নতুন আঙিনায়। আমরা কয়েকজন একসঙ্গে বসে আছি। কেউ কেউ হাঁটছে। আর কেউ অপারের প্ল্যাটফর্মে নিশ্চিন্তে কাঁথা বিছিয়ে শীতে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমাচ্ছে। বলছিলাম পথশিশু ও ঠিকানাবিহীন মানুষদের কথা। স্টেশনগুলো যাদের আবাসস্থল। যাদের দিন কাটে একমুঠো খাবারের সন্ধানে আর রাত কাটে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর জন্য বাধাহীন একটু সমতল জায়গার খোঁজে। মাঝে মধ্যে তাদের দেখলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ি। এই ভেবে যে, আল্লাহতায়ালা আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন তাদের তুলনায়। আর তাদের জন্য দোয়া করা ছাড়া আমার কাছে তেমন কিছুই নেই। যাদের দেওয়ার অনেক কিছু আছে; তাদের নেই দানের বিশাল হৃদয়। আর যার কিছুই নেই; তাদের রয়েছে ভালোবাসা ভরপুর প্রশস্ত হৃদয়। মধ্যরাত শেষ হতে চলল। শেষ রাতের আগমন ঘটবে বুঝি! এখনো নেই সেই কাঙ্ক্ষিত ট্রেন! আর কতক্ষণ…! আর কতটা অপেক্ষা…! এমন কনকনে শীতের রাতে প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষা মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার চেয়েও কম নয়। ট্রেন দেড়টায় আসার কথা থাকলেও আসল না ৩টা বেজেও। একবার স্টেশনমাস্টারকেও জিজ্ঞাসা করলাম। শুধু বলল; আসবে। দিল না কোনো সঠিক টাইম। এই ট্রেনটা প্রায় সময় লেট করে আসে। কিন্তু; এতটা লেট কখনো করে না। হয়তোবা কোথাও কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। না হয় ঠিক টাইমেই আসত। বিকাল ৪টায় ক্যাম্পাস থেকে বাসে ওঠে স্টেশনে নামি সন্ধ্যা ৭টায়। আর এখন রাত ৩টা। জেগে জেগে কেটে গেল পুরোটা রাত। জীবনে এই প্রথম এমন অভিজ্ঞতা হলো। যা মনে থাকবে জীবনের শেষ অবধি। বসে থাকতে ভালো লাগছিল না আর। তাই, ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে হাঁটছিলাম। আচমকা স্টেশনের বেল বেজে উঠল; যা ট্রেন আসার জানান দেয়। একটু পর মাইকে এনাউন্সমেন্ট; “অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কুড়িগ্রামগামী ‘কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস’ দুই নাম্বার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াবে।” এটা শুনে হৃদয়জুড়ে অজান্তেই খুশির ঢেউ খেলে গেল। মুখে ফুটল একচিলতে বিজয়ের হাসি; যা ছিল অপেক্ষার। প্রহর শেষ হতে চলছে। তখন বাজে ৫টা। দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। একটু একটু করে অদূরে ট্রেনের অবয়ব সামনে ভেসে উঠল। আর হরদম বেজে চলছে যার ঝনঝনা ঝন শব্দ। ‘যাত্রা শুভ হোক’ এমন বাক্যই এখন অন্তরে।
প্রকাশিত:
• দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ (০৪.০১.২৩)
https://www.protidinersangbad.com/todays-newspaper/campus/373945
আপনার মতামত লিখুন :