ভোট দেব যাকে খুশি


আখতার হোসেন আজাদ প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৩, ২০২৩, ৭:৪১ অপরাহ্ণ /
ভোট দেব যাকে খুশি

আখতার হোসেন আজাদ: গতকাল রাতে কুষ্টিয়ার মধুপুর বাজারে একটি হোটেলে খাবার খেয়ে ক্যাম্পাসে আসার জন্য আমরা তিনজন বন্ধু ভ্যানের অপেক্ষা করছি। রাস্তার পাশেই একটি চায়ের দোকান। দোকানির সাথে গল্প করছি। এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করলাম মামা, ভোটের অবস্থা কিরকম দেখছেন? চোখে আতঙ্কের ছাপ নিয়েই উত্তর দিলেন মামা, আপনারা ভার্সিটিতে পড়েন। জানিনা আপনারা কে কোন দল করেন। তবে এখন ভয়ে কেউ কোনো কথা কইতে পারছেনা। (পাশের একটি দোকান দেখিয়ে বললেন) ঐ যে দোকানটা দেখছেন, একটু আগেই ভেঙ্গে দিল। ঐ দোকানদার বলেছিল, এইবার সরকার আর টিকতে পারবেনা। জনগণ অতিষ্ঠ। কেউ আর ভোট দিবেনা। তাতেই ওরে মাইরা ওর দোকান ভাংচুর কইরা চইল্যা গেছে। তারপর আশেপাশের নির্বাচনী পোস্টারগুলো দেখিয়ে বললেন দেখছেন না, অন্য কারো পোস্টার নাই।
আমাদের দেশের রাষ্ট্রপরিচালকেরা দাবী করেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান। লোক প্রশাসন বিভাগের ছাত্র হওয়ায় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অবশ্য একটু ভালভাবেই জানি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকলের মত প্রকাশের অধিকার থাকার কথা। কিন্তু পূর্বের ঘটনাটির সাথে পাঠ্যবইয়ের গণতন্ত্রের সংজ্ঞার মিল খুঁজে পেতে আমার বেশ কষ্টই হলো।
পৃথিবীর কোনো কল্যানমূখী রাষ্ট্রে আমাদের দেশের মতো নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতা হয় কিনা তা আমার জানা নেই। নির্বাচন আসলেই পত্রিকার পাতা উল্টালে, টেলিভিশন চালু করলেই ভেসে উঠে নির্বাচনী প্রচারে বাঁধা, হামলা প্রভৃতি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার উদ্দেশ্য হল জনগণের সেবক নির্ধারণ করা যারা কিনা তাঁর এলাকার উন্নয়ন করবে, নাগরিকের আশা-আকাক্সক্ষা-চাহিদা পূরণ করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের দিতে দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যায়, সকলেই হয়ত মনের গভীরে গেঁথে নিয়েছেন নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়া মানেই ক্ষমতা হাতে পাওয়া। তারপর নির্বাচিত হবার পরেই প্রথম ও প্রধান কর্মসূচিটি যেন বিরোধী শক্তিকে দমন করা এবং নির্বাচনের পূর্বে দেওয়া প্রতিশ্রæতিসমূহ ভুলে যাওয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটির ধারাবাহিকতা যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে সকলেই এটি বজায় রেখেছে। স্বাধীনতা অর্জন করার ৪৭ বছর পরেও নির্বাচন আসলেই আমাদের দেশের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলেরই মনে এক চাপা আতঙ্ক কাজ করা শুরু করে। এই পরিস্থিতির জন্য আমি দায়ী করতে চাই রাজনীতিকদের জেদাজেদি, একগুঁয়েমিতা, অদূরদর্শিতা, প্রতিহিংসা ও রেষারেষি কর্মকান্ডকে। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম এই গতানুগতিক রাজনীতির ধারা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই। আমরা এমন রাজনীতির চর্চা দেখতে চাই, যার মূল লক্ষ্য থাকবে ক্ষমতা নয়, জনগণের সেবা। কিন্তু এটি অবশ্য সত্য যে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা কাজে না হোক অন্তত বক্তৃতার মঞ্চে এই নীতিবাক্যটি ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের নেতারা মুখে যতই বলুক না কেন যে ধর্মের নামে রাজনীতি বন্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু নির্বাচন আসলেই দেখা যায় সেইসব ব্যক্তিই ধর্মকে পুঁজি করে, ধর্মীয় পোশাক পরেই ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনা করেন। রাজনীতিতে যখন ধর্ম প্রসঙ্গটি চলেই এলো তখন আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনবোধ করছি। বাংলাদেশে অন্যতম বৃহৎ ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করতে পারবে কি পারবেনা এটি যেন এখন সর্বমহলে অন্যতম প্রশ্ন। বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা টকশোতে এসে টিভির পর্দা কাঁপিয়ে তুলছেন। আমার মতে বিষয়টি জনগণের উপর ছেড়ে দেওয়ায় হবে উত্তম পন্থা। এইবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন। নির্বাচনের ফলাফলেই অনেকটা বোঝা যাবে জনগণের কাছে বর্তমানে দলটির জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, এইবারের নির্বাচনে জামায়াত জোটগতভাবে লড়ছে। এই প্রশ্নের চির সমাধান ঘটানোর জন্য একটি গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে। জনগণ ঠিক করে দিবে এদেশের মাটিতে জামায়াতের ভবিষ্যৎ কি? নির্বাহী আদেশে যদি জামায়াতের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করা হয়, তবে কালের বিবর্তনে তা আবার আলোচনায় আসবে এবং এতে দ্ব›েদ্বর অবসান মোটেও হবেনা।
নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা যেন আমাদের দেশের নির্বাচনের একটি অন্যতম ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে প্রধান দুইটি জোটকেই জনগণের কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, নির্বাচনে উভয়ই সহনশীল আচরণ করবে এবং জনগণের দেওয়া রায় নির্দ্বিধায় মেনে নিবে। তবে সরকারি দলের থেকে এইক্ষেত্রে প্রত্যাশা বেশি থাকবে। ক্ষমতার অপব্যবহার না করে সকল দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণার সমান সুযোগ দিতে হবে। বিরোধী প্রার্থীর পোস্টার ছেঁড়া, নির্বাচনী প্রচারে বাঁধা দেওয়া, হামলার রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে। সরকারের জোটের বাইরে থাকা দলগুলোকেও সহনশীল আচরণ করতে হবে। উস্কানিমূলক বক্তব্য কিংবা কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন জনগণের কল্যাণে তারা কাজ করবে, চলমান উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডকে সচল রাখবে, বিরোধী শক্তিকে নিপীড়ন করার মতো নিকৃষ্ট পন্থা অবলম্বন বন্ধ করবে, প্রতিহিংসার রাজনীতি চর্চা বন্ধ করবে এই সকল দলকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে এবং সর্বসাধারণ যেন ভোটকেন্দ্রে যেয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে এইরকম পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রধান দুই জোটকেই দায়িত্ব নিতে হবে। জনগণ ভোট দিলে জাতীয় সংসদে যাব, নচেৎ জনগণের পাশে থেকে গঠনমূলক সমালোচনা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব এই পণ যদি সকল দলের প্রার্থীদের হয়, নির্দ্বিধায় বলতে পারি শান্তির পথ আর দূরে নেই।

প্রকাশিত: দৈনিক যুগান্তর

প্রকাশকাল: ১২ ডিসেম্বর, ২০১৮

৩০.১২.২০১৮ যুগান্তর