আশিকুর রহমান: আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে কেনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশ। আত্মহনন কোনো ব্যক্তির জীবৎকালে এমন কোনো কর্ম যাতে তার সুস্থতা বিঘ্নিত হয় কিংবা অস্তিত্ব বিপন্নতার মুখোমুখি হয়। এ সমস্যা মানবজাতির সূচনালগ্ন থেকেই একটা যন্ত্রনাদায়ক বাস্তবতায় দাঁড়িয়েছিল এবং এখনো আছে। তবে মজার ব্যাপার হলো-কেউ সফল হয়ে মারা গেলে মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন মামলা চলে না। রাষ্ট্র নিজেও বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না। কিন্তু মরতে মরতে বেঁচে গেলে আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ বলবত দণ্ডবিধির (পেনাল কোড ১৮৬০) ৩০৯ ধারায় ১ (এক) বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এখন প্রশ্ন জাগে- কে, কখন আর কেন-ই বা আত্মহত্যা করছে? এরুপ প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা নানাবিধ কারন তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে বর্ধিত জীবনযাপনের পরিস্থিতিতে স্থায়ী ও অসহনশীল মনে হলে অনেকে প্রশান্তি পেতে আত্মহত্যা করে। মানুষ নানা কারণে আত্মহননের মত যন্ত্রনাদায়ক পথ বেছে নেন। এর মধ্যে হতাশা, দরিদ্রতা, বেকারত্ব ও প্রেম-ঘটিত সমস্যা অন্যতম। তাছাড়াও মানসিক রোগ, ব্যক্তিত্বে সমস্যা, মাদকাসক্তি, এনজাইটি, অপরাধবোধ, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, অশিক্ষা, দাম্পত্য কলহ, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা, যৌন নির্যাতন, মা-বাবার প্রতি অভিমান, পরিক্ষায় খারাপ ফলাফল, পারিবারিক কলহ ও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে এই পথ বেছে নেয়। আবার অনেকের আত্মহত্যার পিছনের কারণ অজানা। সম্প্রতি বরিশালের জনপ্রিয় আবৃত্তিকার ও সাংস্কৃতিক কর্মী সামসুন্নাহার নিপা আত্মহত্যা করেছেন। বিগত দিনে দেখা গিয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের আবির বিন আজাদ নামে এক শিক্ষার্থী হতাশা জনিত কারনে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যাকারী যে কারণে বা যে ব্যক্তির ওপর অভিমানে নিজের প্রাননাশ করছে তার মৃত্যু পরবর্তী অনুভূতি একবার ভেবেছে কি? দিনশেষে নিজের জীবন বিলীন ছাড়া আর কিছুই নয়। চারপাশের প্রভাব আর জীবনের সংকীর্ণতার তুলনায় জীবন মহৎ ও মূল্যবান। জীবন উপলব্ধি করার বিষয়, বিসর্জনের নয়। বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে থাকে। বাংলাদেশে সিংহভাগ আত্মহননের প্রবণতা লক্ষ করা যায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে। প্রাইভেটের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীর হার বেশি। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যার হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারন- অর্থনৈতিক। একটি বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন যা ২০২০ সালে ছিল ৭৯ জন। মোট আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৫ জন পুরুষ এবং মোট শিক্ষার্থীদের ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। তবে বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীর আত্মহত্যার হার অধিক।
আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমেই একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা আত্মহত্যা করে জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়। ফলে তাদের সম্ভাবনাময় সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়। এতে পরিবার ও সমাজে তরুণদের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। দেশে প্রতি লাখে সাত দশমিক আট জন মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- বাংলাদেশে আত্মহত্যা প্রবণ বেশিরভাগই ১৫-২৯ বছর বয়সি। এতে দিনে দিনে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ব্যাহত হচ্ছে। অন্য ব্যক্তির প্ররোচনায় ও প্রতারণার শিকার হয়ে আত্মহননের পথ বেচে নেয় অনেকে। বর্তমান সমাজে তরুনদের মধ্যে অনেকাংশে এই প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। সন্দেহ হয় এই আত্মঘাতী পদ্ধতি সমাজে প্রচলন না হয়। অধিকাংশ ব্যক্তি আত্মহননের পূর্বে মনে করেন ‘আত্নহত্যাই মুক্তি’। প্রকৃতপক্ষে,এটি সামাজিক ও ধর্মীয় অপরাধ। ব্যক্তিগত ও সামাজিক কোন দায়বদ্ধতা না রাখি; কারন জীবন অমূল্য, একটাই। জীবন নির্দিষ্ট সফলতায় সীমাবদ্ধ নয় বরং জীবনকে উপভোগ ও সফল করার বহু উপায় রয়েছে। তাই ক্ষণস্থায়ী সমস্যার ফলে নিকৃষ্ট পথে পা দেয়া বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। পৃথিবীই শেষ নয় বরং যারা কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাসী তারা বিশ্বাস করে মৃত্যু পরবর্তী জীবন আছে। তাই এই নিকৃষ্ট পথে পা বাড়ানো থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। বরং নিজেকে গড়ুন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্টের জন্য কিছু করুন। আপনি ভাল থাকবেন, পরিবার ও রাষ্ট্র উভয়ই ভালো থাকবে।
নিজের জীবন শেষ করার মধ্যে কোন সমাধান লুকিয়ে নেই বরং সকল বাধা-বিপত্তি পেড়িয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকিয়ে থাকতে পারাই প্রতিটি জীবনের লক্ষ হওয়া উচিত। প্রশ্ন হলো-আমাদের এই প্রজন্মের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা যদি আত্মহত্যার মত অপ্রত্যাশিত অপরিণামদর্শী এই পথ বেছে নেয় তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে আমরা কোথায় দাঁড়াব? আত্মহত্যা যেমন ক্রমেই বাড়ছে তেমনি বিশ্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় ধরে আত্মহত্যা কমানোর চেষ্টা করে আসছে। এই নিকৃষ্ট পথ প্রতিরোধের ওপর সহস্র বই ও গবেষনাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে, এসবের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আত্মহননের কারনগুলো অনুসন্ধান করে তার সমাধান করতে হবে, ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে। আত্মহত্যার কুফল ও প্রতিরোধ বিষয়ক কর্মশালার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এই নিকৃষ্ট কাজের শাস্তি থাকলেও এর প্রয়োগ ও আইনি সংশোধন করে প্রয়োজনে কঠোর করতে হবে। আমাদের উচিত ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভাবে আত্মহত্যা প্রবন মানুষের প্রতি সহমর্মিতা বাড়িয়ে দেয়া, বন্ধুত্ব বাড়িয়ে দেয়া। সবার জীবন হোক প্রস্ফুটিত ফুলের মত যেন অকালে অকারণে ঝরে না যায়; এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
প্রকাশকাল: ১৪ আগস্ট, ২০২২
প্রকাশিত: দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ।
লিংক: https://epaper.alokitobangladesh.com/
প্রকাশিত: বাংলাদেশ বুলেটিন (০৮.০৮.২০২২)
লিংক: https://epaper.bd-bulletin.com/2022/08/08/index.php
আপনার মতামত লিখুন :