কাগজের বৃষ্টি
মামুন মিসবাহ: কে যেন হটাৎ পেছন থেকে হাতরুমাল দিয়ে রিয়াদের নাক-মুখ চেপে ধরল। কিছু বোঝার আগেই টান দিয়ে দ্রুত একটা কালো মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিলো। রিয়াদ ছোট্ট মানুষ। বয়স সাত কিংবা আট হবে। হালকা-পাতলা গড়নের। গায়ে তেমন শক্তিও নেই। তবুও দুই হাত দিয়ে শক্ত হাতটা মুখ থেকে সরানোর অনেক চেষ্টা করলো সে; কিন্তু পারল না। কিছু সময় হাত-পা দাপিয়ে গোঁঙাতে গোঁঙাতে নিমিষেই নেতিয়ে পড়ল। কিছুই করার ছিল না তার। শক্তিহীন নিস্তেজ শরীরটা আগন্তুক মানুষটার কোলে ঠিক মরা মানুষের মতো পড়ে রইল।
কয়েকঘণ্টা পর রিয়াদের জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলতেই দেখতে পেলো ফ্যান ঘুরছে উপরে। ঠিক মেঝের মাঝবরাবরে পড়ে আছে সে। চারদেয়ালের ছোট্ট একটা রুম। একটাই কাঠের দরজা। আশপাশে কতগুলো পুরনো আসবাবপত্র। মাকড়শা বাসা বেঁধেছে ঘরের কোণায় কোণায়। দেখেই মনে হচ্ছে, এটা কারো থাকার ঘর নয়। কখনো কখনো হয়তো কেউ ব্যবহার করে থাকে। লাইটগুলো বন্ধ। তবে, অন্ধকার ছিল না। সবকিছু দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট। চাঁদের জোছনাটুকু খোলা জানালার গ্রিল ভেদ করে নির্দ্বিধায় ঢুকছিলো রুমে। উঠে বসলো সে। চারদিকে চোখ ঘুরাতেই তার বয়সী আরো কয়েকজনকে দেখে বুঝতে পারলো; তাদের তুলে আনা হয়েছে। কেউ চুপচাপ বসে আছে। কেউবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর কেউ শুধু তার দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারায় একধরণের অসহায়ত্ব। রিয়াদ বুঝতে পারে, তারা মানুষ পাচারকারী চক্রের হাতে পড়েছে! এই ভেবে ভয় পেয়ে বসে তার তনু-মন। শুনেছে, তারা নাকি জবাই করে কিডনি বিক্রি করে দেয়! কেউ কেউ নাকি আবার বিদেশেও মানুষ পাচার করে দেয়! মা বারবার বলত,
‘রাতে বাইরে যাসনে খোকা; বাচ্চাধরা তুইলা নিয়ে যাইবে, সাবধান! সাবধান! ভুলেও যাসনে খোকা।’
কাঠের দরজাটা বন্ধ। বাইরে দরজার পাশে থাকা কারো অস্পষ্ট সুরেলা আওয়াজ আসছিল। কেউ হয়তো পাহারা দিচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। রাত এখন কয়টা বাজে কে জানে! সবকিছুই যেন ভিন্ন ভিন্ন লাগছে। রিয়াদ মনটাকে শক্ত করে। উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখার চেষ্টা করে বাইরের পরিবেশ। উপর থেকে সরাসরি নিচে তেমন কিছু দেখা যায় না। বহুতলাবিশিষ্ট কোনো ভবনে আছে হয়তো তারা। আশপাশে আরো কয়েকটি ভবন। কোনোটার আবার কাজ চলছে। আর কিছু অফিস দেখা যাচ্ছে। তবে, বোঝা যচ্ছিল, সুনসান নীরবতাঘেরা এক মহারাত্রি। কাউকে আওয়াজ দিয়েও লাভ হবে না। পুরো পৃথিবী যে এখন ঘুমন্ত। তা ছাড়াও আওয়াজ পৌঁছবে না নিচে। রিয়াদ মেঝেতে বসে পড়ে আবার। সকলের মতো নীরব হয়ে থাকে। কাঁদতে মন চাচ্ছে তার। কিন্তু, চোখের কোণায় কেন জানি পানি আসছে না। শুকিয়ে গেছে অশ্রু হয়তো।
সকাল হলো। কেউ একজন এসে দরজা খুলে খাবার দিয়ে গেল। রুটি-কলা আর পানি। লোকটা মাস্ক পরা। কর্কশ ভাষায় বলে উঠল,
‘দ্রুত খেয়ে নাও সবাই। কোনো সাউন্ড করবে না’ একটা ছেলে দৌড় দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করলে লোকটা তাকে ধরে দূরে ছুড়ে মারল। সে কান্না করতে শুরু করল উচ্চস্বরে। লোকটা কাছে গিয়ে মুখে আঙুল চেপে ধরে বলতে লাগল,
‘একদম চুপ। কোনো আওয়াজ করবি না। আওয়াজ করলে সোজা ছাদ থেকে ফেলে দিব নিচে। বুঝলি!’
এদিকে আরেকটা ছেলে বলতে লাগল,
‘আমাদের ধরে আনছেন কেন? আমরা আপনাদের কী ক্ষতি করছি? দয়া করে আমাদের ছেড়ে দিন। প্লিজ! প্লিজ’
লোকটা এবার উঠে গিয়ে কোনো কথা না বলে ঠাস করে তার গালে একটা চড় মেরে বসল। হুংকার দিয়ে বলে উঠল,
‘কোনো কথা হবে না আর! বাঁচতে চাইলে একদম চুপ থাকবি। না হলে একটা একটা করে ধরে ছাদ থেকে ফেলে দিব।’
এই বলে দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে যায় সে। সবাই আর কিছু না বলে চুপচাপ কলা-রুটি খেতে শুরু করে।
কিছুক্ষণ পর দুইজন এসে সবাইকে ছাদে নিয়ে যায়। ছাদ তাদের মাথার উপরেই ছিল। এক এক করে সবাইকে ন্যাড়া করে দিতে থাকে। ন্যাড়া কেন করাচ্ছে, সেটা কারো বুঝে আসছিল না। রিয়াদের সিরিয়াল সবার শেষে। ততক্ষণে সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে পুরো ছাদ দেখছিল। পালিয়ে যাওয়ার পথ খু্ঁজছিল। তবে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালানো প্রায় অসম্ভব। নিচে তাদের লোক আছে নিশ্চিত। গেলেই ধরে ফেলবে মেবি। ছাদ থেকে লাফ দেওয়াও সম্ভব নয়। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার দৃষ্টিতে পড়ে ওয়াশরুমের পাইপের দিকে। যা সোজা নিচের দিকে নেমে গেছে। সেটা বেয়ে বেয়ে নিচে নামতে হবে। খুব রিস্কি। পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু জীবন বাঁচাতে চাইলে রিস্ক তো নিতেই হবে। তবে এখন পাইপ দিয়ে নামতে গেলে নিচে গিয়ে ধরে ফেলবে ওরা। এসব ভাবতে ভাবতে সিরিয়াল আসে তার। ন্যাড়া করে দেওয়া হয় তাকে। সবাইকে ন্যাড়া করা শেষ হলে আবার ঘরে নিয়ে গিয়ে আঁটকে রাখে।
রিয়াদ ভাবতে থাকে। কীভাবে এখান থেকে বাঁচা যায়। ফোনও তো নেই সঙ্গে, যে কাউকে কল করে বলবে এখান থেকে বাঁচাতে। পকেটে শুধু একটা কলম রয়েছে। সেটা দিয়ে কী আর করবে! কিছু বুঝে আসছে না। রিয়াদ পুরো রুমে পায়চারি করতে থাকে। বাকিরা সবাই নীরব হয়ে বসে। কেউবা মেঝেতে শুয়ে পড়ছে। কারো চোখে আর জল নেই। শুকিয়ে গেছে সব। চিল্লালে কেউ শোনে না নিচ থেকে তেমন। ওরা আওয়াজ শুনতে পেলে ঘরে ঢুকে মারে। অমানুষের দল। দয়া-মায়া বলতে কিছু নেই তাদের। এহেন পরিস্থিতিতে এই ছোট ছোট বাচ্চারা কী বা আর করতে পারে! না আছে তেমন বুদ্ধি, না আছে শক্তি!
দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। দুপুরে একবার কিছু খাবার দিয়ে গিয়েছিল। তারপর আর খবর নাই। হঠাৎ রিয়াদের চোখ যায় রুমের এককোণে পড়ে থাকা একটা খাতার উপর। সেটা সে হাতে নেয়। কতগুলো ফাঁকা পৃষ্ঠা রয়েছে। বাকিগুলো লেখায় ভরা। কিছু হিসাবপাতি আর কি! সে তার পকেট থেকে কলমটা বের করে। বসে পড়ে নিচে। একটা সাদা পেজ থেকে একটুকরো কাগজ ছেঁড়ে। সবাই তার কাছাকাছি চলে আসে। দেখতে থাকে রিয়াদ কী করে? সকলের চোখ একটুকরো কাগজের দিকে। রিয়াদ খাতার উপর কাগজ রেখে লেখে,
‘দয়া করে আমাদের বাঁচান। আমরা শিশু। আমাদের তুলে এনে একদম উপরতলার একঘরে বন্দী করে রেখেছে। প্লিজ, আমাদের কেউ বাঁচান’
তারপর কাগজটাকে হাতের মুঠোয় চেপে জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। যদি কেউ দেখে তাহলে হয়তো সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে। কিছুক্ষণ পর আরও কয়েকটা কাগজ নিচে ফেলে দেয় তারা। কিন্তু, কোনো সাড়া আসে না । এভাবে ঘণ্টাখানেক চলে যায়। এরপর ওদের থেকে কেউ একজন বলে ওঠে, কয়েকটা কাগজ দিয়ে হবে না। আমাদের বৃষ্টির মতো কাগজ ফেলতে হবে নিচে। তাহলে একজন হলেও সেটা দেখবে হয়তো । যেই কথা সেই কাজ। পুরো খাতাটা সবাই টুকরো টুকরো কাগজে আলাদা করতে থাকে । আর রিয়াদ সাহায্যের কথা লিখতে থাকে। একসময় সব কাজ শেষ হয়ে যায়। সবাই হাতের মুঠোয় কাগজের টুকরোগুলো নিয়ে জানালা দিয়ে একসাথে ফেলে দেয়। সেগুলো বৃষ্টির মতো নিচে পড়তে থাকে। আর সবাই নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে বুকভরা আশা নিয়ে।
ঘণ্টাখানিক পর হঠাৎ দরজার সামনে কারো উপস্থিতি টের পায় সবাই। নড়েচড়ে ওঠে প্রত্যেকে। দুয়েকজন উঠে দরজার দিকেও যায়। ততক্ষণে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে। কেউ একজন দরজা খুলছে। সবাই মন থেকে চাচ্ছে যেন সাহায্য আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে । পাচারকারীদের কেউ যেন না হয়। দরজা খুলে সামনে দাড়ায় একজন ব্যক্তি। অন্ধকারে পুরোপুরি চেহারা না দেখা গেলেও মধ্যবয়স্ক কোনো ব্যক্তি বলে মনে হয়। আওয়াজ ছোট করে বলে ওঠে,
‘দ্রুত পালাও। দাঁড়িয়ে দেখছো কী? নয়তো ওরা সবাই এসে পড়বে।’
এমন কথা শুনে সবাই বের হয়ে পালায়। কেউ ছোটে সিঁড়ি বেয়ে নিচে। কেউ ছোটে ছাদের দিকে; যদি নিচে কেউ ধরে ফেলে আবার সেই ভয়ে। তার মধ্যে ছিল রিয়াদও। ছাদে গিয়ে তারা ওয়াশরুমের পাইপ বেয়ে বেয়ে নিরাপদে নিচে নামে। পেছন সাইড থাকায় কেউ দেখতে পায়নি। কারো দোকান থেকে কল করে বাড়িও ফেরে নিরাপদে।
বাড়িতে যাওয়ার পর রিয়াদের মনে কিছু প্রশ্ন চেপে বসে। বাকি যারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেছিল তাদের কী হয়েছিল? তারা কি বাড়িতে ফিরেছিল নাকি ধরা পড়ে যায়? আসলে লোকটি কে ছিল? তিনি কি আমাদের ফেলা কাগজের টুকরো পেয়ে উপরে এসেছিল? নাকি উনি পাচারকারীদের মধ্য থেকেই একজন ছিলেন? তবে, রিয়াদ সব কনফিউশন দূরে ছুড়ে মেরে ভেবে নেয়, তারা আল্লাহর রহমতে তাদের সেই কাগজের বৃষ্টির কারণেই নীড়ে ফিরেছে। এটাই ঠিক হবে বুঝি ভাবা!
প্রথম প্রকাশিত গল্প
• দৈনিক ইনকিলাব (১৪.০৭.২০২৩)
লিংক:
https://dailyinqilab.com/literature/article/587279
• দৈনিক আজাদী (১৫.০৭.২০২৩)
লিংক:
https://urlis.net/xiu758gm
• জনকণ্ঠ (২১.০৬.২০২৩)
লিংক: https://www.dailyjanakantha.com/literature/news/693575
আপনার মতামত লিখুন :