স্মৃতির আঙিনায় শৈশবের ঈদ
মামুন মিসবাহ: শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে এখন যৌবনের সোনালী অধ্যায়ে বিচরণ করছি। কিন্তু, ভুলিনি সেই শৈশবের দুরন্তপনা। ভুলিনি শৈশবে ফেলে আসা অগোছালো সব আনন্দদায়ক স্মৃতি। চোখ বন্ধ করলে হৃদয়ের আঙিনায় ভেসে ওঠে; শৈশবের নানান প্রকার খেলাধুলার চিত্র, ছুটিতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা বা গোল মিটিং, ঈদের আগে যতসব নতুন জিনিসের আবদার, কোথাও বসে ঈদের দিনে বন্ধুদের ঈদসালামি হিসেবের আগ্রহভরা মুহূর্ত ও একসাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার অভিনব সব পরিকল্পনা। এইসবে একটু খেয়াল দিলেই মন আর থাকে না বর্তমানে, অতীতের সব স্মৃতিতে হারিয়ে যায়। মন যদি কোথাও ফিরে যাওয়ার আশা রাখে; সেটা শৈশব ছাড়া আর কোথাও নয়। এই স্মৃতিদের ভিড়ে ঈদের স্মৃতিগুলো একটু অন্যরকম। গেঁথে রয়েছে হৃদয়ের গতরজুড়ে। ঈদ এলেই তা কথা বলে। একা পেলেই হাঁকিয়ে নিয়ে যায় শৈশবের বিস্তৃত ময়দানে।
এক.
ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে শৈশবে ছিলো ভিন্ন আয়োজন। কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রতি ঈদে চাঁদ দেখতাম অতি উৎসাহ নিয়ে। বলতে গেলে, ছোট-খাটো ‘চাঁদ দেখা কমিটি’ ছিল আমাদের। শাকিল, আসিফ, মাইদুল, বিপুল, লাবু মমিনুলসহ আমি ছিলাম চাঁদ দেখা কমিটির মূল সদস্য। ঈদুল ফিতরের আগের দিন এবং ঈদুল আজহার আগের দিন ঠিক সন্ধ্যায় পৌঁছে যেতাম রুবি আপুদের পুকুরপাড়ে। সেখান থেকে ঈদের চাঁদ পরিস্কারভাবে দেখা যেতো। গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম আকাশের দিকে। চাঁদ দেখা গেলেই হলো! কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। ‘চাঁদ উঠেছে, হুররে’ এই চিৎকার দিতে দিতে সবাই দৌড়ে যেতাম বাড়ির দিকে। সবগুলো ঘরে ঢুকে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলতে থাকতাম, আম্মু! ভাইয়া! আপু! ‘চাঁদ উঠেছে, কালকে ঈদ’, ‘চাঁদ উঠেছে, কালকে ঈদ’।
দুই.
রাতে আমরা একত্র হতাম পিটিআই মাঠে। লুকোচুরি খেলতাম খুব আনন্দে। যে চোর হতো, তার কষ্ট হয়ে যেতো অনেক। অন্ধকারে আমাদের খুঁজে পাওয়া অতোটাও সহজ ছিলো না। তাছাড়াও পিটিআই এর এরিয়া বিশাল। ছাদ থেকে শুরু করে গাছে ওঠা, বিল্ডিংয়ের পেছনে; যে যেখানে সুযোগ পেতাম, লুকিয়ে পড়তাম। খুঁজে পাওয়া কঠিন হওয়ায় দেখা যেতো, একজনকে কয়েকবার করে চোর হতে হতো। সেই সময়টা এতোটাই আনন্দের ছিল যে, মনে-প্রাণে চাইতাম, সময়টা শেষ হয়ে না যাক। কারণ, ঈদ ছাড়া বাকি দিনগুলোতে রাতে বাইরে বের হওয়া বাড়ি থেকে কঠোরভাবে নিষেধ ছিল। সেই রাতের জন্য এক ঈদ থেকে আরেক ঈদ অপেক্ষা করা লাগতো। এই জন্য সেই রাতটা আমাদের সবার জন্য ছিল স্পেশাল। এখনো একসাথে হলে সেই রাতের আলোচনা করি আনন্দস্রোতে ভেসে। প্রত্যেকের সাথে ঘটা প্রসিদ্ধ ঘটনাগুলো হেলে-দুলে উপভোগ করি।
তিন.
সকালে দ্রুত উঠে গোসল সেরে নতুন জামা-কাপড় পরার ইচ্ছেটা ঈদের রাতের মূল ভাবনা। চোখ বন্ধ করে শুধু এটাই ভাবতাম, কখন সকাল হবে! আর আমি আমার নতুন পাঞ্জাবিটা গায়ে দিবো! কখনো স্বপ্নে দেখতাম, নতুন জামা পরে হাঁটছি বাড়িতে। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে দেখতাম, এখনো সকালই হয়নি। আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। এভাবেই পুরো রাত কেটে যেতো। অবশেষে যখন সকাল হতো, দ্রুত গোসল সেরে বায়না ধরতাম নতুন জামা-পাঞ্জাবির। চোখে পানি ছাড়া হাত-পা দাপিয়ে কান্না করতাম এই বলে; আম্মু! নতুন জামা, নতুন জামা। আম্মু যতই বলতো, দিচ্ছি, ততই আমার কান্নার আওয়াজ বেড়ে যেতো। একসময় নতুন জামা পেলে আর আমাকে কে পায়! জামা পরে এই বাড়ি ওই বাড়ি ঘোরা শুরু। কোনো কোনো বাড়িতে সেমাই খাওয়াও হতো। সবাইকে দেখানো শেষ হলে ঈদগাহে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হতো। এভাবেই কাটতো ঈদের সুন্দর সকালটা।
চার.
ঈদের নামাজ পড়া হতো কখনো কখনো বাবার সাথে। বিশেষ করে ঈদুল আজহার দিন। বাবা ইমাম ছিলেন, নামাজ পড়াতেন। নামাজশেষে কুরবানির জন্য মাঠে কাজ করতেন। আর আমি ঘুরতাম তার পেছনে পেছনে। সেই অনুভূটা অন্যরকম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুরবানি দেখা। যাকগে, সেটা কথা নয়। কথা হলো ঈদের সালামি নিয়ে। প্রতি ঈদে আব্বু মোটে পাঁচ টাকা করে দিতেন আমাদের চার ভাই-বোনকে । এই টাকা নিয়ে আমি একটুও খুশি ছিলাম না। সবার ছোট ছিলাম। তার উপর অধিক জেদি। সালামি আরও লাগবে। এই জন্য মায়ের কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতাম। মা সুপারিশ করে আরও পাঁচ দশটাকা এনে দিতেন বাবার কাছ থেকে। সেটা নিয়ে আমাকে আর কে পায়! আর এখন শিশুরা একশর কম সালামি নেয়ই না। আমাদের সময় ওই পাঁচ—দশ টাকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। তবে, ওই টাকা দিয়ে কী করতাম; তার বিশাল ইতিহাস। আজকে থাক। অন্য একসময়।
প্রকাশিত: জুন ২০২৩
ম্যাগজিন: নবধ্বনি
আপনার মতামত লিখুন :