কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে সকাল-সন্ধ্যা


Mamun Misbah প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৩, ২০২৩, ৩:৪৪ অপরাহ্ণ /
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে সকাল-সন্ধ্যা

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে সকাল-সন্ধ্যা

ভ্রমণ মানুষের জীবনে নিয়ে আসে অনেক অনেক পরিবর্তন। উপলব্ধি করায় কিছু ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও কিছু রঙিন মুহূর্ত। বিষন্নতার কালো মেঘ সরিয়ে অন্তরে ফুটিয়ে তোলে লুকিয়ে থাকা সূর্যের আশাজাগানিয়া আলোকরশ্মি। যাতে খুব যতনে লালিত হয় নতুন করে বেঁচে থাকার অদম্য স্পৃহা। কুয়াকাটার সাগরকন্যায় এমনই এক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন—মামুন মিসবাহ

কুয়াকাটা বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার একটি শহর ও পর্যটনকেন্দ্র। যেখানে রয়েছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত; যা পর্যটকদের কাছে ‘সাগরকন্যা’ হিসেবে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক সমুদ্র সৈকত। যার দৈর্ঘ্য ১৫/১৮ কিলোমিটার। বাংলাদেশের একমাত্র সৈকত হিসেবে যেখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। আমরা একশজনের একটি টিম নিয়ে রওনা হলাম কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। কুষ্টিয়া থেকে দুটি বাসে বিভক্ত হয়ে সন্ধ্যাপরবর্তী শুরু হলো আমাদের দীর্ঘ জার্নি। জানা নাই, কখন পৌঁছবো? তবে, সূর্যোদয় উপভোগ করার ইচ্ছেটা সকলের। এজন্যই একটু আগেভাগেই রওনা হওয়া। টিমের সকলের ঠিক কী অবস্থা তখন! কে জানে! তবে, আমার মনজুড়ে আলাদা একটা অনুভূতি দোলা দিচ্ছিল। আজোবধি কখনোই যে যাওয়া হয়নি সাগরপাড়ে! ছুঁয়ে দেখা হয়নি সাগরের অথৈ জল। অথচ সেই সমুদ্র নিয়ে পড়া হয়েছে কবিতার শত শত পঙক্তি। পড়া হয়েছে ভ্রমণকারীদের হাজারও দিনলিপি। তাই বুঝি, একটু বেশি-ই আগ্রহ হৃদয়ে বেঁধেছে বাসা।

যাত্রাপথের উদযাপন
রাত্রির কালো আঁধার ভেদ করে সম্মুখে ছুটে চলছে আমাদের বাসটি। সেই চলন্ত বাসে সংগীত বাজিয়ে ভালোভাবেই ভ্রমণ উদযাপন করছে সবাই। কেউ কেউ মাইক হাতে নিয়ে বেসুরা কণ্ঠে গান গাইছে। শোনাচ্ছে কেউ দারুণ দারুণ জোকস। আবার কেউ বিভিন্ন শ্লোগান তুলে সবাইকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে; যা হৃদয়ের অতলে ফুটিয়ে তুলছে ভিন্নরকম স্বাদ। বলতে গেলে, সবাই ছিল প্রাণবন্ত একটি কাননের কতক জাগ্রত পুষ্পরাজি। একটা সময় সবাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে অনেকজনই। আমারও আর সইছিলো না চোখে। বন্ধ হয়ে আসছিল বারবার। সামনের একটা ফাঁকা আসন দেখে ঘুমিয়ে পড়লাম আমিও। যখন আমার ঘুম ভাঙলো; তখন আর মাত্র কয়েকমিনিটের পথ বাকি। পৌঁছে গেলাম কুয়াকাটার সাগরপাড়ে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সাগর যেন আমাদেরকে দেখে নীরব ভূমিকা পালন করছে। না আছে তার বাঁধভাঙা উত্তাল ঢেউ, না আছে তার ছলাৎ ছলাৎ শব্দের ঝংকার। আঁধারের আড়ালে এক নববধূর সাজে শরমিন্দা হয়ে লুকিয়ে আছে সে। আঁধার ভেদ করে তার কাছে যেতে মন চাচ্ছিলো বারবার। নিয়মের হাত পেছন থেকে বাধা দেওয়ায় ছুটে চললাম আমাদের ভাড়া করা আঙিনায়। ফ্রেস হওয়ার আগে সূর্যোদয় দেখার নিয়ম ভাঙতে মন সায় দিচ্ছিল না।

সূর্যোদয় ও সাতটা স্পট
ফজরের নামাজটা জামাতের সাথে পড়ে রওনা হলাম সূর্যোদয় দেখার জন্য। দুজন দুজন করে ভাগ করে বাইক ভাড়া নিলাম। একই পথের সাতটা স্পট ঘুরেঘুরে দেখাবে তারা। আমার ভাগে পড়ল প্রিয় বন্ধু জুলফিকার। তাকে নিয়ে শুরু হলো বাইকযাত্রা। সাগরের ঠিক পাড় দিয়ে বাইক চলছে। কিছুটা পিচ্ছিল বালুকাময় পথ। মাঝেমধ্যে বাইক পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিলো। তবুও, উপভোগ করছি সাগরপাড়ের ভোরের আবহাওয়া। যেন হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছি অজানা গন্তব্যে। প্রথম স্পটে পৌঁছলাম। কিন্তু, দেখা হল না সূর্যোদয়। মেঘের কারণে সূর্যোদয় ঢাকা পড়ে গেছে। কী আর করার? সাতটা স্পট ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। এরমধ্যে একটা স্পটে গিয়ে নাস্তা করলাম দুজনে মিলে। খিচুরি, ইলিশ ও ভর্তার দারুণ খাবার উপভোগ করলাম। খুবই মজাদার ছিল খাবারটা। এখনও মনে হয় সেই খাবার খেতে আবার ফিরে যাই কুয়াকাটায়। সারাজীবন মনে থাকবে খাবারের কথাটা।

সাগরের বুকে
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর সাগরে ডুব দিতে রওনা হলাম। একটা ফুটবল সাথে নিয়ে। সাগরে নামার আগে কয়েকজন মিলে তোলা হল কয়েকটা ফটো। এরপর নেমে পড়া সাগরের বুকে। ঢেউয়ের প্রথম ধাক্কায় পানি খেয়ে ফেললাম। যা ছিল সত্যি বিষাদময়। লবনাক্ত পানি বলে কথা। একটুপর ঢেউয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠলো। সাগরের ঢেউয়ের সাথে মিলে আমি একাকার। লাফালাফি চলল। ফুটবল দিয়ে চলল কিছু সময় পানিতে হাত দিয়ে বল মারার খেলা। যাকে কাছে পাওয়া যাবে তার উপরে বল ছুড়ে মারা হবে। সত্যি-ই ভিন্ন এক অভিজ্ঞতায় নিজেকে জ্ঞান করলাম উপভোগ্য। গোসল শেষে নামাজ পড়ে রূপচাঁদা মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়া। খুব মজাদার ছিল।

1678347265727

সুন্দরবন ও সমুদ্র ভ্রমণ
দুপুরে সুন্দরবনে যাওয়ার অনেকের প্লান থাকলেও রাজি হলো না কেউ তেমন। আমরা কয়েকজন মাত্র। টিকিট কাটতে হলো। ভ্রমণ হলো সমুদ্রপথে। এই পথের জার্নি ভোলার মতো নয়। সমুদ্রের হাওয়ায় চলছিল যেন ট্রলার। ট্রলারটা ছিল পুরনো আমলের। দেখতে কোনো গোলাকার জিনিসের মতো। বাতাসে গা ভাসিয়ে আমরা চলেছি সুন্দরবনের দিকে। সময় লাগলো দেড় ঘণ্টার মতো। ঘুরে ঘুরে দেখা হলো কুয়াকাটার মিনি সুন্দরবন। ভালোই লাগলো। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথটা বেশ সুন্দর। যা গিয়ে মিলিত হয়েছে সমুদ্রে। নানাধরণের গাছগাছালি। কমতি ছিল শুধু বন্যপ্রাণীদের। সন্ধ্যা অবধি সময় চলে গেলো সেখানেই। মিস করলাম সূর্যাস্তও। গোমড়া মুখে ফিরলেও সন্ধ্যার আবহাওয়ায় সমুদ্রপাড়ে কিছুক্ষণের হাঁটাচলায় ফিরে পেলাম শান্তির সুবাতাস। এশার নামাজ পড়ে নীড়ে ফিরতে শুরু হয় ব্যস্ততা। পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল হয়ে যায়। আল্লাহর রহমতে সহি-সালামতে পোঁছে যাই।

1678347265741
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়কপথে এর দূরত্ব প্রায় ৩৮০ কিলোমিটারের মতো। ঢাকা থেকে বেশ কয়েকটি বাসে করে এখন সরাসরি কুয়াকাটা যাওয়া যায়। সরাসরি দ্রুতি পরিবহন, সাকুরা পরিবহনসহ একাধিক পরিবহনের গাড়িতে গাবতলী কিংবা সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে কুয়াকাটায় যায়। এসব বাসে গেলে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে ২০০ মিটার দূরে নামিয়ে দিবে। ঢাকা থেকে কুয়াকাটা বাসে যেতে সময় লাগে প্রায় ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা।

যা যা ঘুরে দেখবেন
• কুয়াকাটা বৌদ্ধ মন্দির
• ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী নৌকা
• কুয়াকাটার কুয়া
• কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান
• কাউয়ার চর
• চর গঙ্গামতী
• ঝাউবন
• লাল কাঁকড়ার চর
• রূপালী দ্বীপ
• বৌদ্ধ বিহার
• মিষ্টি পানির কূপ
• রাখাইন পল্লী
• বার্মিজ মার্কেট
• শুঁটকি পল্লী
• ঝিনুক বীচ
• লেবুর চর
• তিন নদীর মোহনা
• সুন্দরবনের পূর্বাংশ (ফাতরার বন)
• স্বপ্ন রাজ্য
• পাখি মারা পানি যাদুঘর

প্রকাশিত:
• দৈনিক বাংলা (১৪.০৭.২০২৩)

1678347265767