তরুণ প্রজন্মের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান ও বিকাশ
মামুন মিসবাহ: অন্যকে নিয়ে লিখতে গেলে আমাদের লেখা কম পড়ে না। অনায়াসে লিখতে পারি কয়েকপৃষ্ঠা। বিপত্তি বাধে তখনই; যখন নিজেকে নিয়ে লিখতে বসি। একলাইন লিখতে হিমশিম খেয়ে যাই। কলমটাও মনে হয়ে অভিমানে ধর্মঘট করে বসে। কী লাভ অন্যের সম্পর্কে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখে যদি নিজের সম্পর্কে একপৃষ্ঠাও না লিখতে পারি। এমনটা হওয়ার একমাত্র কারণ; নিজেকে কম পড়া অর্থাৎ নিজের সম্পর্কে কম জানা। অন্যকে বেশি বেশি পড়ার ক্ষেত্রে আমাদের কোন জুড়ি নেই। সেই তুলনায় নিজের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বা পুঁজি অতিসামান্য। এতেই ঢাকা পড়ে যায় আমাদের সুপ্ত প্রতিভাগুলা। আমরা যে সবাই লেখাপড়া করে সফল হব; আসলে তা নয়। সফল হওয়ার পিছনে শিক্ষার বিকল্প নেই; সেটা যেমন ঠিক, তেমনি মানুষকে দেওয়া আল্লাহর নানান প্রতিভা মাধ্যম বানিয়ে সফল হওয়ার গল্প অসত্য ও অলীক নয়। যার দৃষ্টান্তসমূহ আমাদের আশেপাশে মজুুদ রয়েছে অনেক।
সম্প্রতি একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, লেখাপড়ার পাশাপাশি কী কাজ করছ? তোমার কী কী প্রতিভা আছে? বলে, কিছুই নেই। বললাম, খুঁজে দেখেছো কখনো? বলল, না। অথচ তার সম্পর্কে আমি জানি, দারুণ লেখে। লেখার হাত যথেষ্ট ভালো। ইচ্ছে করলে ভালো একজন লেখক হতে পারে। এদিকে আমার এক বন্ধু ছয়-সাতহাজার টাকার একটা চাকরি করে। সখের বশে মোবাইলে ভিডিও ইডিটিং ও ডিজাইনের কাজ করে। তার কাজও মোটামোটি ভালা মানের। ইচ্ছে করলে চাকরির পাশাপাশি সে একটা ল্যাপটপ যোগাড় করে ডিজাইন শিখে ভালো একজন ফ্রিল্যান্সার হতে পারে। হতে পারে কোন ভিডিও ইডিটর। কিন্তু, সেটা না করে অহেতুক নষ্ট করে অবসরের সারা সময়টা। এরকম হাজারও প্রতিভা লুকিয়ে আছে আমাদের মাঝে; কিন্তু আমরা নিজেদের সম্পর্কে বেখবর। তারুণ্যের গুরুত্বপূর্ণ সময়টা নষ্ট করছি হেলায়-খেলায়। আমাদের কেউ কেউ দৌড়াচ্ছে শুধু একটা সার্টিটিফকেটের পেছনে। আবার কেউ কেউ কোশেশ চালাচ্ছে এমন জিনিসের প্রতি যে জিনিসের প্রতিভা তার মাঝে বিন্দুমাত্র নেই। অনেকেই আবার পড়াশোনায় দুর্বল বলে সারাক্ষণ নিজেকে দুষতে থাকে আর বলতে থাকে ‘আমি কোন কামের না, আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না।’ এরকমটা না করে সে যদি নিজের মাঝে প্রতিভার সন্ধান করত তাহলে পেয়ে যেত জীবন যাপনের নানাবিধ পদ্ধতি ও নিরাশার শহরে একবিন্দু আশার মেঘ; যা তাকে এগিয়ে নিত জীবনের সম্মুখপানে।
নিজের প্রতিভা খুঁজে বের করে আবার তা কাজে লাগিয়ে জীবনে সফলতা অর্জন করা; কোন মামুলি বিষয় নয়। সবচে কঠিন বিষয় হলো; প্রতিভার সন্ধান করা। কখনো মনে হবে এটাই আপনার প্রতিভা কিন্তু, দেখা যাবে, মূলত সেটা আপনার নিছক ভালো লাগা। আবার মনে হবে, এটাতে কাজ করতে পারলে হয়তো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে; আসলে সেটা অন্যের সফলতা দেখে শুধু ক্ষণিকের সখের বিষয়। যাতে আপনার বিন্দুমাত্র প্রতিভা নেই। প্রতিভা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। এক. জন্মপ্রতিভা, দুই. অর্জিত প্রতিভা। ‘জন্মপ্রতিভা’ খুব কম মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। এটাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ সহজেই সফল হতে পারে। তবে, তাতেও চেষ্টা ও শ্রম লাগে। আর ‘অর্জিত প্রতিভা’ নিজস্ব চেষ্টা-প্রচেষ্টার উপর নির্ভরশীল। চেষ্টা করলে, দেখা যায় প্রতিভার স্বরূপ। চেষ্টা না করলে মনে হবে অতন্ত কঠিন বিষয়। এই জন্য প্রত্যেকটা বিষয়ে নিজেকে বাজিয়ে দেখা নিতান্তই জরুরি। আরেকটা পদ্ধতিতে নিজের প্রতিভার সন্ধান করা যায়; নিজের ভালো ভালো গুণগুলো খুঁজে খুঁজে সেটাতে নিজের শ্রম ব্যয় করা। হতে পারে সেটাই নিজের উজ্জ্বল আগামী। কিন্তু, নিজের প্রতিভা জানার পরেও শ্রম ব্যয় না করা বা অবহেলায় নিজের প্রতিভা নষ্ট করা নিছক বোকামি ছাড়া কিছু না। তবে, অনেকের প্রতিভা নষ্ট হওয়ার নেপথ্যে অনেক সময় পিতা-মাতার প্রভাব থাকে। তারা তাদের নিজস্ব স্বপ্নটাকে সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়। যাতে সন্তানের স্বপ্ন ও প্রতিভা ঢাকা পড়ে যায়। ঠিক, অনেকেই আবার যথেষ্ট উপকরণ না থাকার কারণে নিজের প্রতিভা খুইয়ে ফেলে। পরবর্তীতে সেটা আফসোসের কারণ হয়ে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির রূপ নেয়।
গোটা এক তরুণ প্রজন্ম ভুগছে এমন এক ব্যাধিতে যার সমাধান একমাত্র; নিজেদের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান ও বিকাশ। এর জন্য নিজেকে নিয়ে পড়াশোনা করার বিকল্প নেই। তাতেই খুঁজে পাওয়া যাবে তারুণ্যের আত্মপরিচয়। আবার বিভিন্ন দিকে নিজেকে বাজিয়ে দেখাও হতে পারে প্রতিভা সন্ধানের সেরা সুযোগ। সেক্ষেত্রে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া আমাদের কর্তব্য। বাকিটা আল্লাহর হাতে। যেমনটা আরবি প্রবাদবাক্যে রয়েছে, যার বাংলায় অর্থ, ‘ চেষ্টা আমার থেকে, পূর্ণ করার দায়িত্ব আল্লাহর।’
প্রকাশিত:
দৈনিক সংবাদ
https://sangbad.net.bd/opinion/mail/89572/
আপনার মতামত লিখুন :