ট্রেনে যাতায়াত নিয়ে কুড়িগ্রামবাসীর ভোগান্তি


Mamun Misbah প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৩, ২০২৩, ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ /
ট্রেনে যাতায়াত নিয়ে কুড়িগ্রামবাসীর ভোগান্তি

ট্রেনে যাতায়াত নিয়ে কুড়িগ্রামবাসীর ভোগান্তি

মামুন মিসবাহ: একটা সময় সরাসরি কুড়িগ্রাম জেলা থেকে ঢাকা পর্যন্ত কোনো ট্রেনই চলত না। একপর্যায়ে এসে কুড়িগ্রামবাসীর জন্য রংপুর এক্সপ্রেসের একটি বগি বরাদ্দ হয়; যার জন্য কুড়িগ্রাম থেকে শাটলে করে কাউনিয়া গিয়ে ধরতে হতো রংপুর এক্সপ্রেস। সে সম্পর্কে আবার কুড়িগ্রামের অনেকেই জানতেন না। দূরপাল্লার বাসনির্ভর যাতায়াতে অভ্যস্ত কুড়িগ্রামের মানুষ। চলাচলে ভাড়ায় গুনতে হতো মোটা অঙ্কের টাকা। ঈদ কিংবা ছুটির দিনের কথা তো ভিন্ন। তাতে আরও গুনতে হতো স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে প্রায় দুই গুণ বেশি। এমনিতেও দারিদ্র্যের বিবেচনায় জেলা হিসেবে কুড়িগ্রামের নাম সবার আগে চলে আসে। যদিও বছরের দুই সময় অর্থাৎ বন্যা ও শীতকালে ক্ষতিগ্রস্তের দিক দিয়ে কুড়িগ্রামের নাম গণমাধ্যমের হেডলাইন হিসেবে দেখা যায়। তবে আজ পর্যন্ত সেই দিক দিয়েও কুড়িগ্রামের উন্নতি চোখে পড়েনি। হয়নি বন্যাকবলিত ও শীতার্ত মানুষদের কোনো সার্বিক উপকার বা নদীভাঙনের মতো বড় ক্ষতি থেকে বাঁচাতেও নেয়া হয়নি কোনো বিকল্প উদ্যোগ। সবকিছু ঠিক আগের মতোই রয়েছে।

অনেক অপেক্ষার পর জেলার নামানুসারে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস নামে ২০২০ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা ও কুড়িগ্রামের মধ্যে চলাচলকারী প্রথম আন্তঃনগর ট্রেন উদ্বোধন করা হয়; যা ১৭ অক্টোবর থেকে ঢাকা-কুড়িগ্রাম রুটে চলাচল শুরু করে। যার বেজ হলো কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। প্রথম দিকে যাত্রীসংখ্যা কম হলেও ধীরে ধীরে মানুষ ট্রেনমুখী হতে শুরু করে। ভাড়া কম, পাশাপাশি আনন্দদায়ক জার্নি। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ধারিত আসন, নির্বাচিত স্টেশন, ট্রেন বিলম্ব ও চলাচলের রুট।

প্রথমত, ট্রেনের মোট আসন আপ-ডাউন হিসেবে ৫৯৬ এবং ৬২৬টি। কিন্তু কুড়িগ্রাম রেলস্টেশনের বুকিং সহকারী মনিরুজ্জামান লিটনের ভাষ্যমতে, কুড়িগ্রামের জন্য আসন সংখ্যা ১২১টি মাত্র। কারও কারও মতে, ১০০টি। অন্য এক তথ্যমতে, ঢাকা অভিমুখী কুড়িগ্রামের আসন সংখ্যা ১৮২টি। যেখানে কুড়িগ্রাম থেকে রংপুরের আসন সংখ্যা বেশি। আবার আসন রয়েছে পার্বতীপুর ও অন্যান্য স্টেশনের জন্যও। যেহেতু ট্রেনটি রংপুর-পার্বতীপুর ভায়া হয়ে চলাচল করে। প্রশ্ন হলো, কুড়িগ্রামের জন্য এত কম আসন বরাদ্দ কেন? অথচ কুড়িগ্রামের জন্যই এই ট্রেন চালু করা। এই আসন কম হওয়ার কারণে অনেক মানুষ যাতায়াত করতে পারে না। টিকিট নামক সোনার হরিণ সবার ভাগ্যে জোটেও না। এটা কুড়িগ্রাম জেলার মানুষদের বেশ ভোগাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, এই ট্রেন শুধু কুড়িগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনেই বিরতি দেয়। কুড়িগ্রাম থেকে ছেড়ে দিলে সামনে পড়ে টগরাইহাট ও রাজারহাট। বহুদিন ধরে রাজারহাটের মানুষ আবেদন করে আসছেন যেন রাজারহাটে বিরতি দেয়া হয়। কিন্তু নেয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। অথচ রাজারহাট থেকে কুড়িগ্রাম স্টেশন বেশ খানি দূরে। রাজারহাটে বিরতি দিলে সেখানকার মানুষসহ টগরাইহাটেরও লোকজন ট্রেনে উঠতে সহজ হবে। সুবিধা পাবেন তিস্তার মানুষও। এদিকে নাগেশ্বরী-ভুরুঙ্গামারীর লোকদের তো কুড়িগ্রাম এসে ট্রেনে উঠতে হয়। সেদিকে তো ট্রেন পৌঁছার রুটও নেই। উলিপুর-চিলমারী পর্যন্ত লাইন থাকলেও সেদিকে ট্রেন যায় না। স্টপেজ শুধু কুড়িগ্রাম রেলস্টেশন। এ নিয়ে কথা বলেও কাজ হয়নি। চিলমারীকে শেষ স্টপেজ বানালে উপকৃত হতেন উলিপুর-চিলমারীসহ রৌমারীর মানুষও। কিন্তু উদ্যোগ নেয়ার কথা শোনা গেলেও বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।

তৃতীয়ত, ট্রেন বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহের একটা দিনও সময়মতো ছাড়ে না। বৃহস্পতিবার সময়মতো ছেড়েও দেখা যায় ঢাকা থেকে বিলম্বে ছাড়ে। স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে হয়। এসব দেখলে মনে হয়, কুড়িগ্রামের মানুষ কতটা ভোগান্তি ফেস করে! কখনও কখনও কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসকে বসিয়ে রেখে অন্য ট্রেন ছেড়ে দেয়া হয়; যা খুবই দুঃখজনক। কমলাপুর স্টেশনে এসব প্রায় সময় দেখা যায়। উত্তরবঙ্গ বলে কি এমন করে? জানা নেই। ক্রসিং তো প্রায় নিত্যদিনের সমস্যা। কুড়িগ্রাম থেকে দেরিতে ট্রেন ছাড়লে টঙ্গী যাওয়ার পর শুরু হয় ক্রসিং। মাঝেমধ্যে আধা ঘণ্টার পথ, পৌঁছতে চলে যায় অলমোস্ট ২-৩ ঘণ্টা; যা সত্যি বিরক্তিকর। ভোগান্তিতে ফেলে সব যাত্রীদের।

চতুর্থত, দেশে নতুন রেললাইন স্থাপিত হয়েছে। পুরোনো রেলপথে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। এসব বিবেচনায় নিলে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধায় রেলসেবা বাড়েনি তেমন। তা ছাড়াও বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের রেলপথ নেই। যার দরুন রংপুর বিভাগের যাত্রীদের জয়পুরহাট-নাটোর ঘুরে যেতে হয়। এতে টাকাও বেশি যায়, পাশাপাশি বিড়ম্বনা ফ্রি। অনেক আগ থেকে শোনা যাচ্ছে, সেদিকে একটা রেললাইন হবে। আজ পর্যন্ত তার দেখা মেলেনি। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস কাউনিয়া-বগুড়া হয়েও যেতে পারে লালমনি এক্সপ্রেস ও রংপুর এক্সপ্রেসের মতো। তাতে অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা কমে আসত। কিন্তু না, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ঘুরে আসে রংপুর-পার্বতীপুর-জয়পুরহাট হয়ে। যাতে বিড়ম্বনা ও বিরক্তি দুটোই। প্রায় সবদিক দিয়ে কুড়িগ্রামবাসী ভুক্তভোগী। কেন এত অবহেলা! বুঝে আসে না।

আরেকটা বিষয়, প্রত্যেক ঈদে কিন্তু ঈদ স্পেশাল ট্রেন চলে। এটা সবাই জানি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, উত্তরবঙ্গের জন্য কোনো ঈদ স্পেশাল রাখা হয় না তেমন। গত ঈদুল ফিতরেও রাখা হয়নি। এমনকি কুড়িগ্রামের জন্যও। এবার ঈদুল আজহায় লালমনিরহাটের জন্য একটা ঈদ স্পেশাল মনে হয় রাখা হয়েছে। এত বৈষম্য কেন উত্তরবঙ্গের প্রতি? এত অবহেলা কেন রংপুর বিভাগের প্রতি? এর উত্তর কি কারও কাছে আছ? রংপুর একটা বিভাগ। অথচ দিবারাত্রি ট্রেন নেই রংপুর থেকে। একটা ট্রেন মাত্র। রংপুরের অন্তর্গত অন্যান্য জেলার জন্যও একটা করে মাত্র। বিভাগ হিসেবে রংপুরের জন্য তো অন্তত দুটি ট্রেন দেয়া দরকার ছিল। যেমনটা রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রামের জন্য রয়েছে একাধিক ট্রেন। এটাকে বৈষম্য না বলে কী বলা যায়। সর্বশেষে এসব দিক বিবেচনা করলে কুড়িগ্রামসহ উত্তরবঙ্গের লোকেরা সবাই ভুক্তভোগী। সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, দ্রুত এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে সুবিধাজনক পদক্ষেপ নেয়া হোক। বৈষম্য ও অবহেলা থেকে সবাইকে মুক্ত করে জনসেবার ও মানুষের ভোগান্তির কথা ভাবা হোক।

প্রকাশ:
• দৈনিক ভোরের কাগজ (০৪.০৭.২৩)
লিংক: https://urlis.net/c4r08on5
• দৈনিক শেয়ার বিজ (০৫.০৭.২৩)
লিংক: https://urlis.net/330jy0b0