স্বপ্ন ও শিক্ষাব্যবস্থা: চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন জরুরি
Mamun Misbah
প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৩, ২০২৩, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ /
০
পড়া হয়েছে ২৯
স্বপ্ন ও শিক্ষাব্যবস্থা: চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন জরুরি
মামুন মিসবাহ: আদিকাল থেকেই চলে আসছে জ্ঞানচর্চা। মাধ্যম ও ব্যবস্থাপনা ভিন্ন হলেও আদিযুগের জ্ঞানচর্চার বিষয়টা সর্বজন স্বীকৃত। যুগযুগ ধরে চলে আসা এই জ্ঞানচর্চাই মানবসমাজের কল্যাণের প্রধান বাহক। উন্নতি সাধনের মূল্যবান হাতিয়ার। কালের আবর্তনে জ্ঞানচর্চা ঠিক থাকলেও যুগবিবেচনায় নানারূপ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থায়। সাথেসাথে বদলেছে শিক্ষাগ্রহনে মানুষের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও চিন্তাধারা। সময়ের সঙ্গে ভিন্নভিন্ন রূপ নিয়েছে তার গতিপ্রকৃতিও।
“একটা সময় পৃথিবীর সবজায়গায় গুরু-শিষ্য পরম্পরার শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত এই পরম্পরা চলে এসেছে। ধীরেধীরে তার আমূল পরিবর্তন ঘটে। লুপ্ত হয় প্রথাগত গুরুকুল শিক্ষাব্যবস্থা। আগমন ঘটে ইংরেজি শিক্ষার। বিশেষ করে বাংলাদেশে নবাবি আমলের পাঠশালা টোল বা মক্তবের পড়াশোনার বাইরেও ইংরেজি শিক্ষা চালু করে ইংরেজরা। যা এখন প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা নামে পরিচিত। ”
বিশ্বের প্রতিটি দেশ কিন্তু এক নয়। এক নয় তাদের চিন্তাধারা ও জীবনব্যবস্থা। বাংলাদেশের মানুষের জীবনব্যবস্থা অর্থনির্ভর। অর্থের বিবেচনায় তাদের জীবনব্যবস্থায় ভিন্নতা দেখা যায়। ধনী-গরিবের বিভেদ সেখানেই পরিলক্ষিত হয়। সেই হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ তিনভাগে বিভক্ত—উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের অর্থের কোন সমস্যা না থাকায় তারা নির্দ্বিধায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু, তাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থীরাই লেখাপড়ায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে থাকে। অধিকাংশই বিলাসিতায় ডুবে নিজের ক্যারিয়ারের দিকে নজর দেয় না। শুধু সার্টিফিকেট শো করাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ব্যাপারটা ভিন্ন। তাদের স্বপ্ন থাকে, যদিও তাদের কেউকেউ অর্থের অভাবে শিক্ষা চালিয়ে নিতে পারে না; অকালেই ঝরে যায়। তবে তাদের শিক্ষাগ্রহনে উৎসাহ ও উদ্দীপনা কোনো অংশেই কম নয়।
যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ অর্থনির্ভর জীবনব্যবস্থায় চালিত। অর্থ ছাড়া তাদের জীবন কখনোই কল্পনা করতে পারে না। সেহেতু শিক্ষাগ্রহনের মূল উদ্দেশ্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থ। যা প্রতিটি পরিবারে ভালোভাবে খেয়াল করা যায়। কোন কোন শিক্ষার্থীর জ্ঞানচর্চায় পাণ্ডিত্য অর্জন লক্ষ্য থাকলেও পরিবারের কাছে অর্থটাই উদ্দেশ্য হওয়ায় তাকে তার স্বপ্ন পূরণ করার ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হয়। এমনকি তাদের কাছে শিক্ষার্থীদের প্রতিভার কোন দাম নেই। যার যেদিকে প্রতিভা সেদিকে তাকে সাপোর্ট না করে জোর করে ডাক্তার-ইন্জিনিয়ার বানানোই তাদের মূল দায়িত্ব। বাবা-মার স্বপ্নই এখন সন্তানের স্বপ্ন; চাই সন্তানের সেদিকটায় উৎসাহ বা প্রতিভা থাকুক বা না থাকুক। এভাবেই সন্তানের স্বপ্নগুলো স্বপ্ন-ই রয়ে যায়। ভবিষ্যতে সেই স্বপ্নের ভার এসে পড়ে তাদের সন্তানের উপর। সেটা পূরণে শিশুকাল থেকেই তাদেরকে চাপে রাখা হয়। চার-পাঁচটা প্রাইভেট, কোচিং, নিয়মমাফিক পিঠে একাগাদা বই ঝুলিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় স্কুলে। ছোটকালে এমন চাপ সহ্য করা শিশুটা বড় হতে হতে একজন রোবটে পরিণত হয়। নিজ স্বপ্ন ও প্রতিভা অজান্তেই ভুলে বসে। এই হলো বর্তমান আধুনিক শিক্ষা নিয়ে মানুষের আধুনিক চিন্তাধারা। যার কুফল ও বিরূপ প্রভাব সমাজ এবং দেশের উন্নতির উপর সমানভাবে পড়ছে। এতে জ্ঞানচর্চার মূল উদ্দেশ্য খামখেয়ালীপনায় হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের সংখ্যা কমছে নিয়মিত।
এমনটার ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থাও কম দায়ী নয়। শিক্ষাব্যবস্থা এখন বর্তমানে একগাদা সার্টিফেকেটের নাম। ফাইভ থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত বা তারও বেশি শুধু সার্টিফেকেটই দেখা যায়। শিক্ষা বলতে কিছু নেই। মাস্টার্স শেষ করতে করতে চব্বিশ বছর পেরিয়ে যায়। এরপর চাকরি-বাকরি, বিয়ে-শাদি, সন্তান-সন্ততি নিয়ে সময়টা চলে যায় এভাবেই। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সময়টা কোথায়! লেখাপড়া শেষ করেও অযোগ্যতা ভরপুর। স্বশিক্ষিত হলেও সুশিক্ষিত নয়। কর্মজীবনে দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ ইত্যাদিতে জড়িত। পরিপূর্ণ শিক্ষা না থাকায় একেকজন হয়ে উঠছে শিক্ষিত মূর্খ। এমন শিক্ষাব্যবস্থার কারণে পড়াশোনায় মনোযোগী না হয়ে বাহিরের নানাকাজে ব্যস্ত থাকছে তারা। প্রেম, রাজনীতি ইত্যাদি কাজে তাদের সময় চলে যাচ্ছে। কারণ তারা জানে—দিনশেষে সার্টিফিকেট থাকলে আর কী লাগে! সমাজ এবং দেশ উভয়েই স্যালুট দিয়ে আমাকে বরণ করে নিবে। এককথায় বর্তমান সার্টিফিকেটেই আসল। ভেতরে শিক্ষা থাকুক বা না থাকুক। পরিবার ও সমাজে এর কোন যায় আসে না।
এই বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হলে অবশ্যই স্বপ্ন ও শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে আমাদের মন-মানসিকতা এবং চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন জরুরি। পরিবারকে অবশ্যই তাদের সন্তানদের স্বপ্ন ও প্রতিভার দিকে নজর দিতে হবে। সন্তানকে রাখতে হবে চিন্তামুক্ত। জানি এবং মানি—অর্থ ছাড়া জীবন চলে না; তবে অর্থকে জীবনের উদ্দেশ্য বানানো কোনভাবেই সহিহ নয়। সময় ও বাস্তবতার দিকে খেয়াল রেখে নিজেকে অবশ্যই শক্ত মানসিকতার হতে হবে। তাহলেই সমাজ ও দেশ তরুণ প্রজন্ম থেকে ভালো কিছু আশা করবে। পাল্টাতে হবে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা। উন্নত দেশগুলোর দিকে খেয়াল রেখে তৈরি করতে হবে আগামী প্রজন্মের শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা।
প্রকাশকাল:
• দৈনিক সকালের সময় (১৩.১১.২২)
• দৈনিক জবাবদিহি (১৪.১১.২২)
• দৈনিক আমার বার্তা (১৪.১১.২২)
• দৈনিক সংবাদ (২০.১১.২২)
আপনার মতামত লিখুন :