রুহুল আমিন: গন্তব্যহীন যাত্রা কোথায় যাবো কেউ জানিনা। রাতে কয়েকজন বসে চায়ের আড্ডায় গল্প উঠলো চল কোন জায়গায় ঘুরতে যাই। কেউ খুলনা, কেউ ঝিনাইদহ, কেউ পদ্মা সেতু আবার কেউ বললো কুষ্টিয়ার কোথাও যায়। শেষে সিদ্ধান্ত হলো মাসের শেষের দিক সবার হাতখালি দূরে কোথাও না গিয়ে কাছাকাছি কোথাও যাওয়া যাক। সকাল নয়টার ক্যাম্পাস বাসে চড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য বের হলাম। আমি, সজিব জিয়া মোড় থেকে উঠলাম কুষ্টিয়াগামী বাসে। অমিত ফোন দিয়ে বললো মেইন গেটে ঐ বাস থেকে নেমে ঝিনাইদহের বাসে উঠতে। আমি মনিকান্ত ঝিনাইদহের বাসে উঠেছি। মেইন গেটে আমাদের সাথে রাজিব যুক্ত হলো। আমরা তিনজন ঝিনাইদহের বাসে উঠে অমিত ও মনিকান্তের সাথে পাঁচজনে ঝিনাইদহ উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। বাসের মধ্যে ঝিনাইদহে কোথায় কোথায় ঘুরবো আলোচনা হতে লাগলো। সজিব বললো মিয়ার দালান কাছে আছে ওখান থেকে ঘুরে দুইটার ক্যাম্পাস বাসে ফিরবো। মনিকান্ত বললো যে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে এশিয়া মহাদেশের প্রাচীন ও অন্যতম বৃহত্তম বটবৃক্ষ দেখতে যাবো। অমিত গুগল ম্যাপ এবং মনিকান্ত তার এক সিনিয়র আপুর থেকে বটবৃক্ষ ভ্রমণের জন্য বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে নিলো। ঝিনাইদহ হামদহ মোড় থেকে অটো ভাড়া করে রওনা দিলাম বটবৃক্ষ দেখার উদ্দেশ্যে। অটোওয়ালা মামা রাস্তা চিনেন না। নলডাঙ্গা হয়ে যেতে চাইলেন। ঝিনাইদহ-নলডাঙ্গা রোডের পাশে লাগানো সারি সারি নারিকেল গাছ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। সজিব নেমে ছবি তোলার জন্য অটোচালক মামাকে থামতে বললেন। সবাই মিলে একটা গ্রুপ ছবি তোলার পর বৃষ্টি নামলে সজিবের একাকী ছবি তোলার চাহিদাটা বাকি রয়ে যায়। সে যাত্রা পথে এ বিষয় নিয়ে আফসোস করতে থাকে। অবশেষে মল্লিকপুরে বটবৃক্ষের কাছে পৌঁছালাম। বটবৃক্ষটি প্রায় ২৫০-৩০০ বছর আগে কুমারের কুয়ার দেওয়ালে জন্মেছিলো। মূল গাছটি মারা গেলেও ৪৫ টি ভিন্ন ভিন্ন গাছ ২.০৮ জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। ৩৪৫ টি বায়বীয় মূল মাটিতে প্রবেশ করছে এবং ৩৮টি মূল ঝুলন্ত অবস্থায় বিদ্যামান। ২০০৯ সাল থেকে সামাজিক বন বিভাগ এটি সংরক্ষণ করছে। সেখানে কিছু ছবি তোলার পর বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টি থামার পর আমরা ঝিনাইদহের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ঝিনাইদহ এসে দুপুরের খাবার খেয়ে ঝিনাইদহ কে. সি. কলেজে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে আমরা মিয়ার দালানে যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম। আশ্চর্য জনক হলেও সত্য এবারের অটোচালক মামাও রাস্তা ভুল করে অন্য দিকে চলে গেলো। পথে এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করে আমরা রাস্তা সম্পর্কে ধরানা নিয়ে মিয়ার দালানে গেলাম। সেখানে প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর বিভিন্ন নিদর্শন পেলাম। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তির সাথে মিয়ার দালান বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে জানলাম। সেলিম চৌধুরী নামে ভারতীয় রাজপুত্র খ্রিস্টান ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করার কারণে তাকে তার পরিবার থেকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। সে স্রোতস্বিনী নবগঙ্গা দিয়ে যাওয়ার পথে সেখানে বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন জমিদারের কাছে খাজনা দিয়ে ভারত থেকে পাঁচ/ছয়জন মিস্ত্রি এবং জ্বীনদের সহায়তায় বাড়িটি নির্মাণ করেন। দীর্ঘদিন সেখানে বসবাস করে মারা গেলে বাড়িটি জমিদাররা নিলামে তোলেন। চট্রগ্রামের এক ব্যাক্তি বাড়িটি ক্রয় করেন। জ্বীন-ভূতদের অত্যাচারে সেখানে না থাকতে পেরে সে বাড়িটি আবারও বিক্রি করেন। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির বাপ দাদারা বাড়িটি ক্রয় করেন। তারা ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক বরাবর বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে সংরক্ষণ করার দাবি জানালেও সেটি কোন কাজে আসেনি। মিয়ার দালান থেকে ঝিনাইদহ আসার পথে সজিব বলতে লাগলো দেবদারু যাবে। এটি তার ঝিনাইদহ শহরে প্রথমবার যাত্রা। হঠাৎ ঝটিকা সফরে মেহেদী অনুপস্থিত থাকায় স্রোতস্বিনী নবগঙ্গার তীরে দেবদারুতে বসে ভিডিও কলে যুক্ত করে তার শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করলো অমিত। সন্ধ্যা অতিবাহিত হলো আর কালক্ষেপণ করা যাবে না ৭:৩০ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ক্যাম্পাসে ফিরতে হবে সেজন্য পায়ে হেঁটে মুজিব চত্বরের দিকে রওনা দিলাম। ছাত্র জীবনের এই হাসিমাখা দিনগুলো স্বর্ণালি অক্ষরে লেখা থাকবে জীবন নামের বইয়ের পাতায়।
প্রকাশ কাল: ১৮ সেপ্টেম্বর এবং ৪ অক্টোবর , ২০২২
প্রকাশিত: খোলাকাগজ এবং প্রতিদিনের সংবাদ
আপনার মতামত লিখুন :