রুহুল আমিন: স্বাধীনতার লাড়াইয়ে আমাদের বিজয়ের পেছনে ছিলো সম্মুখযুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধার সাহসিকতাপূর্ণ অংশগ্রহণ। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার অবদানের রাষ্ট্রও সেই সোনার ছেলেদের বরণ করে নিয়েছিল বিভিন্ন বীরত্ব সূচক খেতাব দিয়ে। বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক হচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠ। লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে প্রথম শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল। তার জন্ম ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে বরিশালের দৌলতখানার পশ্চিম হাজীপাড়া গ্রামে। তার পিতা হাবিবুর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার। পিতার সেনাবাহিনীর চাকরি কারণে তার শৈশব কেটেছে পিতার কর্মস্থল কুমিল্লা সেনানিবাসে। তিনি ছোটবেলা থেকে দুঃসাহসী হিসাবে খ্যাত ছিলেন। ছোটবেলা থেকে সেনানিবাসে বেড়ে উঠার কারণে সৈন্যদের সুশৃঙ্খল কুচকাওয়াজ দেখে কিশোর অবস্থায় কল্পনা করেন সেনা সদস্য হবেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা বেশিদূর করতে পারেননি।প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে দুই-এক বছর পড়ালেখা করেন। পড়ালেখা বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীর চাকরির জন্য স্বপ্ন দেখেন কিন্তু তার পরিবার বাঁধা হয়ে দাড়ায়। পারিবারিক বাঁধার কারণে ২০ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যোগ দেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে নিয়োগ করা হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কুমিল্লায়। ১৯৬৮ সালে চাকরিতে যোগদান করার ওর তার পরিবার তার সন্ধান পান। ১৯৭০ সালে তিনি ১৬ বছরের কিশোরী পেয়ারা বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সময় তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে যান এবং তার অনুপস্থিতিতে যদি ছেলে সন্তান হয় নাম ‘বাচ্চু’ এবং মেয়ে হলে ‘টুনি’ নাম রাখতে বলেন। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কুমিল্লা রেজিমেন্ট কে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটে প্রেরণ করেন। যুদ্ধের সময় সেনানিবাস গুলোতে উত্তাল অবস্থা বিরাজমান ছিলো। মেজর শাফায়াত জামিল পাকিস্তানি চক্রান্ত বুঝতে পেরে পাকিস্তানি অধিনায়ক লে. কর্নেল খিজির হায়াতখান সহ কয়েক জন পাকিস্তানি অফিসার ও সেনাদের গ্রেফতার করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে এন্ডারসন খালের পাঁড়ে। আখাউড়ায় অবস্থিত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণ দিকে থেকে নিরাপত্তার জন্য দরুন গ্রামের দুই নাম্বার প্লাটুন কে নির্দেশ দেয়। মোস্তফা কামাল ২ নং প্লাটুনে কর্তব্যরত ছিলেন। ভালো বক্সার হিসাবে তার সুনাম থাকায় তাকে অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক হিসাবে পদোন্নতি পান। পাকিস্তানি চক্রান্ত বুঝতে পেরে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আশুগঞ্জ, উজানিস্বর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এন্ডারসন খালের পাশ দিয়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলেন। ১৪ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী হেলিকপ্টার গানশীপ, নেভাল গানবোট ও এফ-৮৬ বিমান যোগে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিবাহিনীর উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি আক্রমনের সময় দারুইল গ্রামে আলফা কোম্পানির ২ নং প্লাটুনের সেকশন কমান্ডার হিসাবে ছিলেন মোস্তফা কামাল। পাকিস্তানি আক্রমনের ফলে ২ নং প্লাটুনটির সমস্ত রেশন ধ্বংস হয়ে যায়। নতুন রেশন না আসার কারণে তারা দীর্ঘ সময় অভুক্ত অবস্থায় থাকে। মোস্তফা কামাল মেজর সাফায়েত জামিল কে রেশনে ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। মেজর শাফায়াত জামিল সেখানে রেশনের ব্যবস্থা করেন। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী তীব্র গোলাবর্ষণ শুরু করেন। প্লাটুন কে শক্তিশালী করতে মেজর শাফায়াত জামিল ডি কোম্পানির ১১নং প্লাটুন পাঠান। দিনভর যুদ্ধ চলে। ১৮ এপ্রিল সকালে শত্রুরা দারুইল গ্রামের কাছাকাছি আসেন এবং তাদের একটি দল মুক্তিবাহিনীকে পিছন থেকে ঘিরে ফেলে। দারুইল গ্রাম থেকে আখাউড়া রেলস্টেশনের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিবাহিনীর দল। সেখান থেকে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য নিরবিচ্ছিন্ন কাভার ফায়ারিং এর প্রয়োজন হয়। তিনি কাভার ফায়ারিং এর দায়িত্ব নিয়ে সহযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণের স্থানে ফেরার নির্দেশ দেন। সহযোদ্ধারা তাকেও পিছনে ফেরার অনুরোধ জানান কিন্তু তিনি পিছনে না ফিরে নিজের কর্তব্যে অবিচল ছিলেন। মোস্তাফার নিখুঁত গুলিবর্ষণের ফলে পাকিস্তানের ২০-২৫ জন হতাহত হন। যুদ্ধের একপর্যায়ে তার এল.এম.জি এর গুলি শেষ হয় এবং তিনি মারাত্মক ভাবে জখম হন। পাকিস্তানি সৈনিকরা তাকে ট্রেঞ্চে বসিয়ে বেয়েনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন। গ্রামবাসী মোস্তফা কামালকে তার শাহাদাত স্থানের পাশেই সমাহিত করেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব প্রদান করেন।
প্রকাশ কাল: বিশেষ সংখ্যা, ২০২৩
প্রকাশিত: ডাকঘর ম্যাগাজিন
আপনার মতামত লিখুন :