সহযোগিতা যখন ক্ষতির কারণ


আখতার হোসেন আজাদ প্রকাশের সময় : আগস্ট ১২, ২০২৩, ১০:৪২ অপরাহ্ণ /
সহযোগিতা যখন ক্ষতির কারণ
আখতার হোসেন আজাদ:
এক.
সিফাত ও রিফাত দুই বন্ধু। দুজনই একই কলেজে পড়ে। উভয়েই একে অপরকে খুব সহযোগিতা করে। তবে সিফাত তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানে রিফাতের চেয়ে অনেক এগিয়ে। রিফাতের অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন কাজে সিফাত সহযোগিতা করে। যেমন বিভিন্ন কমর্শালায় অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন করা, বিভিন্ন ফরম পূরণ করে দেওয়াসহ সবকিছুই। সিফাতদের কলেজের নিয়ম ছিল বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষকদের ইমেইলে পাঠাতে হত। সিফাত বরাবরই রিফাতের অ্যাসাইনমেন্ট নিজেই স্যারের ইমেইলে পাঠিয়ে দিত।
একবার সিফাত হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো। বেশকিছুদিন ধরে সে কলেজে যেতে পারলো না। ফলে সিফাত যেমন বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে পারলো না, ঠিক তেমনই রিফাতও পারলো না। কারণ সিফাতের সহযোগিতা পেয়ে প্রায় পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল সে। তারপর একদিন শিক্ষক ক্লাসে রিফাতকে তলব করলেন। অ্যাসাইনমেন্ট জমা না দেবার কারণ জানতে চাইলেন। রিফাত সবকিছু খুলে বললো। স্যার বললেন, দেখো এক বন্ধু অপর বন্ধুকে সহযোগিতা করবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু কখনো কখনো কোন সহযোগিতা পরোক্ষভাবে বিপদের কারণ হতে পারে। সিফাত যদি নিজে মেইল না পাঠিয়ে তোমাকে মেইল পাঠানো শিখিয়ে দিত, তবে তুমি একদিকে যেমন দক্ষ হয়ে উঠতে, অন্যদিকে তোমাকে পরনির্ভরশীল হতে হতো না; সকল অ্যাসাইনমেন্ট তুমি নিজেই জমা দিতে পারতে। তুমি যত দ্রুত সম্ভব এসব জরুরী বিষয় শিখে নিবে। আর সিফাতকে আমার ভালোবাসা জানাবে। আল্লাহর কাছে তার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করি।

দুই.

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা চলছে। জামাল ও কামাল দুই বন্ধু। ভাগ্যক্রমে তাদের দুজনের আসন পাশাপাশি পড়েছে। সকলেই পরীক্ষা দিচ্ছে। এদিকে জামালের খাতা দেখে কামাল হুবহু নিজের খাতায় তা তুলছে। এক পর্যায়ে পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত শিক্ষকের সেটি দৃষ্টিগোচর হলো। শিক্ষক প্রথমবার সাবধান করার পরক্ষণেই আবারও একই কাজ শুরু করলো দুজনে। জামাল নিজের লিখিত উত্তর কামালকে দেখিয়ে সহযোগিতা করছে।

এবার শিক্ষক রাগান্বিত হয়ে দুজনের খাতা কেড়ে নিলেন। জামাল ও কামাল নিজেদের ভুল স্বীকার করে স্যারের কাছে ক্ষমা চাইতে গেল। স্যার কামালকে বললেন, তুমি বলো তো পরীক্ষার খাতায় কি কি লিখেছো? কামাল পরিপূর্ণ উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো। স্যার দুজনকেই বললেন, তোমরা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছো। এরপর জামালের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি যে কাজটি করেছো সেটি অনাকাক্সিক্ষত। পরীক্ষা মূলত মেধা যাচাই করার জন্য। বন্ধুত্ব ভালো। কিন্তু অসৎ সহযোগিতা করা মারাত্মক অপরাধ। সেই সাথে এটি ধর্মীয় দিক দিয়েও গুণাহের পর্যায়ে পড়ে।
এমন কাজ করার ফলে প্রকৃত মেধা যাচাই করা দুষ্কর। কারণ পরীক্ষার হলে বন্ধুকে সহযোগিতা করা মানে পরোক্ষভাবে বন্ধুকে তো বটেই, বরং পুরো দেশ ও জাতির ক্ষতি করা। কারণ একজন একটি বিষয়ে ধারণা না থাকার পরেও যখন পরীক্ষার খাতায় সঠিক উত্তর লিখে তখন সে যেমন তাতে মার্কস পেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়, তেমনই আরেকজন প্রকৃত মেধাবীকে বঞ্চিত করে। মনে করো এভাবে একজন কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি মেডিকেলে ভর্তি হবার সুযোগ পেল। তখন স্বল্প মেধা নিয়ে সে দেশ ও জাতির যতটা না সেবা করবে তার চেয়ে ক্ষতি করবে বেশি। তাই অন্যরা যেন এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে এজন্য তোমাদের দুজনের খাতা ২০ মিনিটের জন্য আমি জমা রাখলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য, জামাল মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও মেডিকেলে ভর্তি হবার সুযোগ পায়নি। কারণ স্বল্প সময়ের পরীক্ষায় ২০ মিনিট পরীক্ষা থেকে বিরত থাকা মানে অনেকখানি পিছিয়ে যাওয়া। কিন্তু জামাল ভেঙে পড়েনি। সে পরের বছরের জন্য মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা শুরু করে। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে। পরের বছর মেডিকেলে ভর্তিপরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ লাভ করে।

তিন.

রাফিদের স্কুলে শিক্ষক-অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মিলনমেলায় মুখোরিত স্কুল ক্যাম্পাস। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেলা শিক্ষা অফিসার। হৃদয়স্পর্শী বক্তব্যে জেলা শিক্ষা অফিসার কুতুব উদ্দিন বলেন, আজকের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আগামীদিনের দেশের কর্ণধার। আমি বিশেষভাবে শিক্ষক ও অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আপনারা শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করবেন। তাদের নানা উদাহরণ দিয়ে বোঝাবেন, কেবলমাত্র পাঠ্যবই মুখস্থ করে তা পরীক্ষার খাতায় উগলে দিলেই প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না। তাদের বুঝিয়ে বলবেন, অন্যের খাতা দেখে লিখে পাস করার মাঝে কোন স্বার্থকতা নেই। মৃত্যুর পরে প্রত্যেকের আবার বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তখন ছোট-বড় প্রত্যেকটি কাজের হিসেব মানুষকে দিতে হবে। তাই কখনো ছোট ছোট মিথ্যেও বলবে না। এমনকি কারো সাথে মজা বা দুষ্টুমির ছলেও কখনো মিথ্যে বলবে না, বন্ধু কষ্ট পায় এমন কথাও বলবে না। সবসময় তোমার বন্ধুদের ভালো কাজে সহযোগিতা করবে, কিন্তু অসৎ কাজে কোন রূপ সহযোগিতা তো নয়ই; বরং তাকে বাঁধা দিবে। তাদের বলবেন, অন্যায় কাজে সহযোগিতা করলে শেষ বিচারের দিন মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
 

এরপর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জেলা শিক্ষা অফিসার বললেন প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীরা। তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে আমার সামনে যেন একেকটি গোলাপ ফুল। আজ যারা আমার সামনে বসে আছো, আগামীদিনে তোমরা এই মঞ্চে আসবে। তবে শিক্ষিত হবার পাশাপাশি নিজেকে একজন আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। সৎ ও চরিত্রবান হবে। তোমার কোন বন্ধু বিপথগামী হলে কখনো তাকে সহযোগিতা করবে না। তাকে বুঝিয়ে সঠিক পথে আনবে। সে যদি সংশোধন না হয় তবে গুরুজনকে তা বলবে। মাদক, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে নিজে যেমন জড়াবে না, অন্যদেরও জড়াতে দিবে না। এসবে কখনো সহযোগিতা করবে না। একটি কথা মনে রাখবে, অন্যায় কাজে সহযোগিতা করাও অন্যায়। দেশের আইনে যেমন এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তেমনই মহান আল্লাহর কাছেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অন্যায় কাজে সহযোগিতা করলে সেই ব্যক্তিটি যেমন বিপথগামী হবে, তেমনই তার দ্বারা পরিবার, সমাজ তথা দেশের ক্ষতি হবে। ধীরে ধীরে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট হবে। তাই এসো, আমরা সকলে শপথ করি।  সকলে ডান হাত সামনে নিয়ে শপথ করলো:
সৎ কাজে করব সহযোগিতা
অসৎ কাজের হবে বিরোধিতা
আমরা নবীন জোরসে বল।
আদর্শ নাগরিক হয়ে গড়ব দেশ
সুখে আর শান্তিতে রইব বেশ
আয়রে নবীন চলরে চল।

আমরা বন্ধুত্বের সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করি। কিন্তু খুব কম সময়ই চিন্তা করি এর ভালো মন্দ দিক। অনেক সময় দেখা যায় সহযোগিতা করার ফলে সাময়িক উর্ণনাভের মতো উপকৃত হলেও প্রকৃতপক্ষে বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রতিটি কাজ বা সহযোগিতা করার পূর্বে আমাদের ভালে ও খারাপ দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে।

 

 

প্রকাশিত: ডেল্ট টাইমস

প্রকাশকাল: ২ ডিসেম্বর, ২০২০

লিংক: https://shorturl.at/sAHR3