ভোগান্তির আরেক নাম গুচ্ছ


ruhul প্রকাশের সময় : আগস্ট ১২, ২০২৩, ১০:০৮ অপরাহ্ণ /
ভোগান্তির আরেক নাম গুচ্ছ

রুহুল আমিন: গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা যেন বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার অন্তরায়।  প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিলো। গুচ্ছের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো হারাতে যাচ্ছে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য, সার্বজনীনতা এবং হয়ে উঠতে উঠছে অঞ্চল কেন্দ্রিক। পূর্বে আমরা একটি বিশ্বিবদ্যালয়ে দেশের ৬৪ জেলার শিক্ষার্থী দেখতে পেতাম। সেখানে সকল শিক্ষার্থী তাদের ভিন্ন ভিন্ন  অঞ্চলের সাংস্কৃতি এবং আঞ্চলিক ভাষা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো। গুচ্ছের ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের জেলার আশেপাশে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি হচ্ছে। ফলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলা অঞ্চল কেন্দিক হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় শিক্ষার্থী বেশী হওয়ায় তারা স্থানীয় একটা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। ফলে দূর দূরান্ত থেকে আশা শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার অনূকূল পরিবেশ পাচ্ছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পড়াশোনা এবং তাদের মেধার বিকাশ বিঘ্নিত হচ্ছে। দ্বিতীয় বারের মতো ২২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে গত দুই বছর উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির এই আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এটি আসলে প্রসাংশার দাবিদার। তবে কি সত্যিই ভোগান্তি কমেছে না বেড়েছে? গত দুই বছরের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার বেহাল দশা দেখে এই প্রশ্ন রয়েই যায়। প্রয়োজনের তাগিদে ২২ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কে গুচ্ছ ভর্তি পরিক্ষায় তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছের বাইরে থেকে নিজেদের ভর্তি কার্যক্রম সম্পুর্ণ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিউপি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি নিজেদের মতো করে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করেছে। তারা গুচ্ছের তুলনায় কম সময়ে তাদের ভর্তি কার্যক্রম সম্পুর্ণ করার ফলে গুচ্ছ ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আগেই ক্লাস শুরু করতে পেরেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেপ্টেম্বরে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পহেলা নভেম্বর তাদের ক্লাস শুরু করেছে। একদিকে গুচ্ছ ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গুলো যখন ক্লাস শুরু করছে তখন তারা প্রথম বর্ষ চুড়ান্ত পরীক্ষা দিতে বসেছে। গুচ্ছ ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গুলো তাদের ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে না পেরও ক্লাস শুরু করছে। গুচ্ছ ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেশন জটে পড়ছে। ফলে তারা তাদের মূল্যবান জীবনের ছয় থেকে আট মাস হারিয়ে ফেলছে। পড়াশোনা শুরু করার আগেই তারা এই ভয়ঙ্কর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী নিজেদের ভর্তি নিয়ে শঙ্কায় থাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় গুলা মেধাবী শিক্ষার্থী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
দ্বিতীয় বারে প্রথম বারের তুলনায় গুচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও এবার কমার সম্ভাবনা রয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে সম্ভাবনা রয়েছে। ২২ জানুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ১৯২ আসন ফাঁকা রেখেই তাদের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু করেন। আসন খালি থাকায় বঞ্চিত হয়েছে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। তাদের শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া কথা জানান। কারণ হিসাবে দীর্ঘ সময় ধরে ভর্তি প্রক্রিয়ায় নানা অব্যবস্থাপনা এবং চাহিদা অনুযায়ী মেধাবী ছাত্র না পাওয়ার কথা বলেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গণবিজ্ঞপ্তি সহ ১৩ বার মেধাতালিকা দেওয়ার পরও তাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারেনি। ফলে তাদের শিক্ষক সমিতির সভায় গুচ্ছে না থাকার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। তবে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় থাকা নিয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আপত্তি থাকলেও;  গুচ্ছভুক্ত সব বিশ্ববিদ্যালয় এতে ‘থাকতে’ উপাচার্যদের এক সভায় একমত হয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারী রাতে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ। ২৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কার্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের সাথে এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেনের সভাপতিত্বে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. তপন কুমার জোদ্দার। তিনি বলেন, গত ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি নিরসনের প্রত্যাশা ছিল। তবে কিন্তু এ ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রিতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় ইবি ভিসির অংশগ্রহণ ও পরে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণ সংক্রান্ত খবর ইবি শিক্ষকদের মাঝে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ফলে আমরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করার বিষয়টি দৃড়ভাবে ব্যক্ত করছি। ১৪ মার্চ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ৫০ টি আসন ফাঁকা রেখে ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করেছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার জোদ্দার বলেন, আমরা কখনো চাই না আসন ফাঁকা রেখে ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়ে যাক কিন্তু সেটাই হচ্ছে। এটা প্রত্যাশিত নয়। আমরা ২১ মার্চের মধ্যে একাডেমিক কাউন্সিল ডেকে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম শুরু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কে বলেছি।

শিক্ষার্থীদের ভ্রমণ ক্লান্তি, আর্থিক সাশ্রয়, ভোগান্তি কমানোর জন্য গুচ্ছের আবির্ভাব হলেও ভোগান্তি কমার চেয়ে ভোগান্তি আরো বেড়েছে। একজন শিক্ষার্থী প্রথমে ভর্তি ফি দিয়ে ভর্তি পরিক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন করতে হয়েছে। আবার ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ফি দিয়ে আবেদন করতে হয়েছে। শিক্ষার্থী ভর্তি জন্য ভাইভা দেওয়ার জন্য এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটাছুটি করতে হচ্ছে।  এছাড়াও নানা অব্যবস্থপনায় প্রায় ৬ মাসেও তাদের ভর্তি কার্যক্রম সম্পুর্ণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে।

যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয় নাই তার আগেই শুরু হয়ে গেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া। রেজাল্টের মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার ফলে প্রায় সকল মেধাবী শিক্ষার্থী দুশ্চিন্তা এড়াতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকে। পরে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলে ভর্তি বাতিল করে আসে। ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন স্বনামধন্য কলেজ গুলোতে সিট ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও ভবিষ্যতে সংকট দেখা দিতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। ভর্তি বাতিল করতে আবার ফি দিতে হয়। এ যেন শিক্ষার্থীদের উপর মরার অপর খাঁড়ার ঘা। যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে হতো তাহলে শিক্ষার্থীরা মানসিক অশান্তি এবং আর্থিক দিক থেকে সাশ্রয়ী হতো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন ফাঁকা থাকতো না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত তাদের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসে শিক্ষার্থী বান্ধব সিদ্ধান্ত নেওয়া। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে দেশের সকল প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেধাবীরা বেশি সুযোগ পেয়ে থাকে। সে সকল মেধাবী শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে গতবারের সমস্যা গুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কেন্দ্রীয় ভাবে মেধাতালিকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পছন্দ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিষয় বন্টন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার পর দ্রুত ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে হবে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে যেসব কারণে ভর্তিতে দীর্ঘ সময় লেগেছে সেগুলো কারণ চিহ্নিত করতে হবে। কারণ অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব দায় ছিলো। বর্তমানে একক দায় নাই, তবে সমন্বিত দায় রয়েছে। সবাই কে একসাথে এগিয়ে এসে সমন্বিত দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। সমন্বিত ভাবে এই প্রক্রিয়া যেন বিলম্বিত না হয় সেজন্য এখন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে হবে। টেকনিক্যাল বিষয় গুলো মেডিকেল এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া কে মডেল হিসাবে ধরে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলো যেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং সার্বজনীনতা না হারায়। এটির ফলে বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল কেন্দ্রিক না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ থেকে মুক্তি, ভ্রমন ক্লান্তি, ভোগান্তি দূর এবং আর্থিক ভাবে সাশ্রয়ী হয় তবেই গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতিতে সার্থকতা আসবে।
প্রকাশ কাল: ২০ মার্চ, ২০২৩

প্রকাশিত: খোলাকাগজ

গুচ্ছ খোলা কাগজ 20.30.23